প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয়। প্যানক্রিয়াটাইটিস এর নিষিদ্ধ খাবারসমূহ

 

প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয় সে সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই অজানা। আজ আমরা আমাদের আর্টিকেলে প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয়, হলে কোন কোন খাবার খাওয়া যাবে,প্যানক্রিয়াটাইটিস এর নিষিদ্ধ খাবারসমূহ এবং এর প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

প্যানক্রিয়াটাইটিস-কেন-হয়
প্যানক্রিয়াটাইটিস একটি মারাত্মক রোগ। এটি কোন ভাইরাল রোগ না হওয়ার কারণে আমরা অনেকেই এটিকে গুরুত্ব দেই না। আজ আমার আমাদের আর্টিকেলে প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয় এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করব।

পোস্ট সূচীপত্র: প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয়

প্যানক্রিয়াটাইটিস কি

প্যানক্রিয়াটাইটিস হলো অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, যা একটি গুরুতর শারীরিক সমস্যা। অগ্ন্যাশয় একটি অঙ্গ যা পাকস্থলীর পেছনে থাকে এবং এটি হরমোন ও এনজাইম উৎপাদন করে। এনজাইমগুলো হজমে সাহায্য করে, এবং হরমোনগুলো রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। প্যানক্রিয়াটাইটিস সাধারণত দুটি প্রধান প্রকারে বিভক্ত:

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস (Acute Pancreatitis): এটি হঠাৎ করে শুরু হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে। সঠিক চিকিৎসা নিলে এটি নিরাময়যোগ্য হয়।

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস (Chronic Pancreatitis): এটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যেখানে অগ্ন্যাশয় ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর কার্যকারিতা কমতে থাকে।

এটি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যেমন: গলব্লাডারের পাথর, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, উচ্চমাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইড, কিছু ধরনের ওষুধ, জিনগত সমস্যা ইত্যাদি। এর কারণে তীব্র পেটের ব্যথা, যা পিঠে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বমি বা বমি ভাব, জ্বর, হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া ইত্যাদি  লক্ষণ দেখা দেয়।প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা সাধারণত হাসপাতালে করাতে হয়। 

প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয়

প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয় তা নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব। প্যানক্রিয়াটাইটিস (Pancreatitis) মূলত অগ্ন্যাশয়ের (প্যানক্রিয়াস) প্রদাহজনিত একটি অবস্থা, যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এটি দুই ধরনের হতে পারে: অ্যাকিউট (Acute) প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং ক্রনিক (Chronic) প্যানক্রিয়াটাইটিস। এখানে প্যানক্রিয়াটাইটিসের সাধারণ কারণগুলো তুলে ধরা হলো:

গলব্লাডারের পাথর (Gallstones): অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে গলব্লাডারের পাথর অন্যতম। গলব্লাডারের পাথর যদি অগ্ন্যাশয়ের এনজাইম নিষ্কাশনের পথ (বিলিয়ারি ডাক্ট) বন্ধ করে দেয়, তবে অগ্ন্যাশয়ের মধ্যে এনজাইম জমা হয়ে প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। এই অবস্থাটি জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন: অ্যালকোহলজনিত প্যানক্রিয়াটাইটিস একাধিক কারণে হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন অগ্ন্যাশয়ের কোষের ক্ষতি করতে পারে এবং এটি ধীরে ধীরে ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে পরিণত হতে পারে। এটি অগ্ন্যাশয়ের স্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে অঙ্গটির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। অ্যালকোহল স্বল্পমেয়াদী প্রদাহ (অ্যাকিউট) বা দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ (ক্রনিক) দুই ধরনের সমস্যাই সৃষ্টি করতে পারে।

উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড লেভেল (Hypertriglyceridemia): যদি রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় (সাধারণত ১০০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার-এর বেশি), তবে এটি অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এটি প্যানক্রিয়াটাইটিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

অধিক কোলেস্টেরল লেভেল (Hyperlipidemia): রক্তে অত্যধিক কোলেস্টেরল থাকলেও প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এটি সাধারণত ফ্যাটি ডায়েট এবং স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

মেডিকেশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধ অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন: অ্যাজাথিওপ্রিন (Azathioprine) এবং মারক্যাপটোপুরিন (6-MP): এই ওষুধগুলো ইমিউনোথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়। অ্যান্টিবায়োটিক: যেমন মেট্রোনিডাজল (Metronidazole) এবং টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline)।ডায়ুরেটিক: যেমন ফিউরোসেমাইড (Furosemide) এবং হাইড্রোক্লোরোথিয়াজাইড (Hydrochlorothiazide)। স্টেরয়েড: যেমন প্রেডনিসোন (Prednisone)। এই ওষুধগুলোর কারণে অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।

আরো পড়ুন: ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়। ফ্যাটি লিভারের লক্ষণসমূহ।

অটোইমিউন প্যানক্রিয়াটাইটিস: অটোইমিউন প্যানক্রিয়াটাইটিস হলো এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলবশত অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলোর আক্রমণ করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। এটি একটি বিরল অবস্থা, তবে চিকিৎসা প্রয়োজন।

আনব্যালান্সড ডায়েট এবং স্থূলতা: অত্যধিক চর্বিযুক্ত খাদ্যাভ্যাস এবং ওজনাধিক্য প্যানক্রিয়াটাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে যারা খুব বেশি পরিমাণে ফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণ করেন এবং কম সক্রিয় জীবনযাপন করেন, তাদের প্যানক্রিয়াটাইটিসের ঝুঁকি বেশি।

জেনেটিক কারণ: কিছু জেনেটিক সমস্যা প্যানক্রিয়াটাইটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস নামক জেনেটিক রোগ, যা অগ্ন্যাশয় ও অন্যান্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া পরিবারে যদি প্যানক্রিয়াটাইটিসের ইতিহাস থাকে, তবে জেনেটিক কারণে এ রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

অ্যাবডোমিনাল ট্রমা বা আঘাত: পেটের আঘাত বা সার্জারি অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতি করে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এতে অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস দেখা দিতে পারে।

ইনফেকশন বা সংক্রমণ: কিছু সংক্রমণ, যেমন মাম্পস বা হেপাটাইটিস, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহের কারণ হতে পারে।

প্রকৃতির অজানা কারণ (Idiopathic Pancreatitis): কিছু ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াটাইটিসের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। এই ধরনের প্যানক্রিয়াটাইটিসকে "ইডিওপ্যাথিক" প্যানক্রিয়াটাইটিস বলা হয়।

প্যানক্রিয়াটাইটিসের সাধারণ কারণগুলো হলো গলব্লাডারের পাথর, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড লেভেল, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এবং জেনেটিক সমস্যা। সঠিক চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করে প্যানক্রিয়াটাইটিসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

প্যানক্রিয়াটাইটিস এর লক্ষণ

প্যানক্রিয়াটাইটিসের লক্ষণ নির্ভর করে এর তীব্রতা ও প্রকারভেদের ওপর। সাধারণত, এটি দুটি প্রধান প্রকারে বিভক্ত: অ্যাকিউট (তীব্র) প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) প্যানক্রিয়াটাইটিস। উভয় প্রকারের লক্ষণ কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের লক্ষণ

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হঠাৎ করে শুরু হয় এবং দ্রুত উপসর্গ দেখা দেয়। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো:

  • তীব্র পেটের ব্যথা: পেটের উপরের অংশে সাধারণত হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, যা পিঠে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • পেট ফুলে যাওয়া ও নরম হওয়া: পেট ফোলা এবং স্পর্শ করলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
  • বমি ও বমি বমি ভাব: বমি হওয়া এবং প্রচণ্ড বমি ভাব সাধারণ লক্ষণ।
  • জ্বর: শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে জ্বর আসতে পারে।
  • হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া: পালস রেট দ্রুত হতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট: কিছু রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে।
  • রক্তচাপ কমে যাওয়া: রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়ার কারণে দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা অনুভব হতে পারে।

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের লক্ষণ:

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:

  • নিয়মিত পেটের উপরের অংশে ব্যথা: ব্যথা হালকা থেকে তীব্র হতে পারে এবং প্রায়ই খাবারের পরে বৃদ্ধি পায়।
  • হজমজনিত সমস্যা: এনজাইমের ঘাটতির কারণে চর্বিজাতীয় খাবার হজমে সমস্যা হতে পারে, যার ফলে ডায়রিয়া বা তৈলাক্ত মল (steatorrhea) হতে পারে।
  • ওজন কমে যাওয়া: খাদ্য হজমের সমস্যার কারণে ওজন কমতে থাকে।
  • ডায়াবেটিস: অগ্ন্যাশয়ের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণে ইনসুলিন উৎপাদন কমে গিয়ে ডায়াবেটিস হতে পারে।
  • পুষ্টির ঘাটতি: পুষ্টির শোষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
    প্যানক্রিয়াটাইটিস-এর-লক্ষণ

জরুরি লক্ষণ:

কিছু ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াটাইটিস জীবন-হুমকির কারণ হতে পারে। নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া উচিত:

  • তীব্র ও অবিরাম পেটের ব্যথা
  • জ্বর এবং শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি
  • দ্রুত হৃদস্পন্দন
  • শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • বমি ও ডায়রিয়া যার ফলে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে
  • প্যানক্রিয়াটাইটিস একটি জটিল অবস্থা, এবং এর সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্যানক্রিয়াটাইটিস থাকলে কোন কোন খাবার খাবেন

প্যানক্রিয়াটাইটিসের রোগীদের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিক খাবার অগ্ন্যাশয়ের ওপর চাপ কমায় এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। সাধারণত, কম চর্বিযুক্ত, সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার:

  • ফলমূল: আপেল, বেরি, আঙুর, পেয়ারা ইত্যাদি।
  • সবজি: ব্রকলি, শসা, পালং শাক, গাজর, শিম ইত্যাদি।
  • পুরো শস্য: ওটস, বাদামি চাল, বার্লি, এবং কোয়িনোয়া।

কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন:

  • তেলমুক্ত মাছ (স্যালমন, টুনা), চর্বিহীন মাংস (মুরগি, টার্কি)।
  • উদ্ভিজ্জ প্রোটিন: মসুর ডাল, মটরশুটি, সয়া পণ্য।
  • ডিমের সাদা অংশ, কিন্তু পুরো ডিম নয় কারণ কুসুমে বেশি চর্বি থাকে।
  • স্বাস্থ্যকর চর্বি (মোট চর্বির পরিমাণ কম রাখতে হবে):
  • অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল, বাদাম এবং চিয়া বীজের মতো উদ্ভিজ্জ চর্বি।
  • তবে সীমিত পরিমাণে, কারণ অতিরিক্ত চর্বি অগ্ন্যাশয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

কম চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলো সাধারণত বেশি চর্বি এবং চিনি সমৃদ্ধ। প্রাকৃতিক চিনি সমৃদ্ধ খাবার বেছে নিন, যেমন ফল।

অন্যান্য টিপস: ছোট ছোট পরিমাণে, কিন্তু ঘন ঘন খাবার খান। এতে অগ্ন্যাশয়ে চাপ কম পড়ে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন। পুষ্টিবিদ বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের তালিকা তৈরি করুন। এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং পুনরায় আক্রমণের ঝুঁকি কমায়।

প্যানক্রিয়াটাইটিস এর নিষিদ্ধ খাবারসমূহ

প্যানক্রিয়াটাইটিস থাকলে কিছু খাবার একেবারে এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এসব খাবার অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ বাড়াতে পারে এবং পরিস্থিতি খারাপ করতে পারে। অগ্ন্যাশয়ের ওপর চাপ কমাতে নিম্নলিখিত খাবারগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে:

উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার

  • ভাজা খাবার: যেমন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস, পকোড়া, ভাজা মাংস।
  • ফাস্ট ফুড: বার্গার, পিজ্জা, চিজ বার্গার।
  • চর্বিযুক্ত মাংস: যেমন, গরুর মাংসের ফ্যাট, মাটন, বেকন, সসেজ।
  • পনির, বাটার, ক্রিম: এই ধরনের দুগ্ধজাত পণ্য উচ্চ চর্বিযুক্ত, যা প্যানক্রিয়াসের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
  • কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট: এসব খাবারে প্রচুর চর্বি ও চিনি থাকে।

অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার

  • মিষ্টি পানীয়: সোডা, সফট ড্রিঙ্ক, মিষ্টি চা।
  • ক্যান্ডি, চকোলেট: এগুলোতে উচ্চমাত্রার চিনি এবং ফ্যাট থাকে।
  • মিষ্টিজাতীয় ডেজার্ট: আইসক্রিম, পুডিং, মিষ্টি পিঠা।

প্রক্রিয়াজাত খাবার

  • প্রসেসড মাংস: সসেজ, হট ডগ, স্যালামি, পেপারোনি।
  • ক্যানড খাবার: ক্যানড সুপ, প্রক্রিয়াজাত সস ইত্যাদি প্রায়ই উচ্চমাত্রার ফ্যাট, চিনি এবং সোডিয়াম ধারণ করে।
  • ফ্রোজেন খাবার: বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত এবং প্যাকেটজাত ফ্রোজেন খাবার, যেমন ফ্রোজেন পিজ্জা, রেডি-টু-ইট মিল।

অ্যালকোহল: অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। এটি প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি এবং অগ্ন্যাশয়কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

মশলাদার ও অ্যাসিডিক খাবার: মশলাদার খাবার: ঝাল মশলা, মরিচ, হট সস ইত্যাদি। টক ফল বা খাবার: লেবু, টমেটো এবং সাইট্রাসজাতীয় ফল যা অ্যাসিডিক এবং প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ বাড়াতে পারে।

আরো পড়ুন: কাজু বাদামের উপকারিতা। জেনে নিন কাজু বাদামের ব্যবহার ও অপকারিতা।

উচ্চ পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট: হোয়াইট ব্রেড, পাস্তা: পরিশোধিত শস্য অগ্ন্যাশয়ে প্রভাব ফেলে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায়, যা নিয়ন্ত্রণ করতে অগ্ন্যাশয়কে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। বেকড পণ্য: যেমন, ডোনাট, ক্রোয়াসঁ, এগুলিতে প্রচুর ফ্যাট এবং শর্করা থাকে।

ক্যাফেইন: অতিরিক্ত ক্যাফেইন (কফি, এনার্জি ড্রিঙ্কস) গ্রহণ অগ্ন্যাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং অস্বস্তি বাড়াতে পারে।

ধূমপান: যদিও এটি খাবার নয়, ধূমপানও প্যানক্রিয়াসের জন্য ক্ষতিকারক এবং প্রদাহ বাড়ানোর একটি প্রধান কারণ।

প্যানক্রিয়াটাইটিস থাকলে উচ্চ চর্বিযুক্ত, মশলাদার, মিষ্টিজাতীয়, প্রক্রিয়াজাত এবং অ্যালকোহলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিবর্তে, কম চর্বিযুক্ত, স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে অগ্ন্যাশয় সুস্থ থাকে এবং প্রদাহের ঝুঁকি কমে।

প্যানক্রিয়াটাইটিস পুনরুদ্ধারের ডায়েট

প্যানক্রিয়াটাইটিস থেকে পুনরুদ্ধার করতে হলে এমন একটি ডায়েট মেনে চলা প্রয়োজন, যা অগ্ন্যাশয়ের ওপর কম চাপ দেয়, প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, এবং শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। এই ডায়েট সাধারণত কম চর্বিযুক্ত, হালকা ও সহজপাচ্য খাবারের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। নিম্নে প্যানক্রিয়াটাইটিস পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সাধারণ ডায়েটের গাইডলাইন দেওয়া হলো:

প্যানক্রিয়াটাইটিস পুনরুদ্ধারের ডায়েটের মূলনীতি:

কম চর্বিযুক্ত খাবার: দৈনিক চর্বি ২০ গ্রাম বা তার কম রাখার চেষ্টা করুন। কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন উৎস বেছে নিন, যেমন চর্বিহীন মুরগির মাংস, মাছ, ডাল, মটরশুঁটি, সয়া পণ্য। ভাজা বা প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।

ছোট ছোট এবং ঘন ঘন খাবার: একবারে অনেক খাবার না খেয়ে, দিনে ৫-৬ বার ছোট ছোট পরিমাণে খাবার খান। এতে অগ্ন্যাশয়কে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় না এবং খাবার হজম করা সহজ হয়।

হালকা ও সহজপাচ্য খাবার: নরম ও হালকা খাবার খান, যেমন ওটস, সিদ্ধ চাল, আলু, স্যুপ, এবং সবজি। টক বা মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো পেটে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: খাবারে প্রচুর ফাইবার যোগ করুন, যেমন সবজি, ফল এবং পুরো শস্য। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে এবং পেটের সমস্যা কমায়।

প্রচুর পানি পান: পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন, যাতে শরীর হাইড্রেট থাকে এবং খাবার হজম প্রক্রিয়া সহজ হয়। ফলের রস (যা চিনি যোগ করা হয়নি), হালকা স্যুপ এবং ডাবের পানি পান করা যেতে পারে।

আরো পড়ুন: আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন বেছে নিন, যেমন মুরগির মাংস, মাছ, ডাল, মটরশুঁটি এবং সয়া পণ্য। ডিমের সাদা অংশও একটি ভালো প্রোটিন উৎস হতে পারে, তবে পুরো ডিম না খাওয়াই ভালো।

চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়ানো: অতিরিক্ত চিনি এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো অগ্ন্যাশয়ের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

পুনরুদ্ধারের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত খাবার:

  • ফল ও সবজি: আপেল, বেরি, আঙুর, গাজর, ব্রকলি, পালং শাক, শসা, কুমড়ো ইত্যাদি। তবে খুব টক ফল এড়িয়ে চলা ভালো, যেমন লেবু, কমলা ইত্যাদি।
  • কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য: স্কিমড দুধ, কম চর্বিযুক্ত দই, এবং কম চর্বিযুক্ত পনির।
  • সম্পূর্ণ শস্য: ওটমিল, বাদামি চাল, বার্লি, এবং পুরো শস্যের পাস্তা।
  • প্রোটিন: চর্বিহীন মাংস, তেলমুক্ত মাছ (স্যালমন, টুনা), এবং সয়া পণ্য।
  • স্বাস্থ্যকর চর্বি (সীমিত পরিমাণে): অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল, বাদাম এবং চিয়া বীজ।

পুনরুদ্ধারে যে খাবারগুলো এড়াতে হবে:

  • উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার: ভাজা খাবার, ফাস্ট ফুড, মাখন, পনির।
  • মশলাদার ও টক খাবার: ঝাল মশলা, মরিচ, টক ফল।
  • অ্যালকোহল: অ্যালকোহল সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা উচিত।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্রক্রিয়াজাত মাংস, ক্যানড খাবার এবং জাঙ্ক ফুড।
  • ক্যাফেইন ও সোডা: কফি, চা এবং মিষ্টি পানীয় এড়ানো উচিত।

প্যানক্রিয়াটাইটিস থেকে পুনরুদ্ধারের সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কম চর্বিযুক্ত, ফাইবার ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার মাধ্যমে অগ্ন্যাশয়কে সুস্থ রাখতে সাহায্য করা যায়।

প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগীর চিকিৎসা

প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগীর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের তীব্রতা, প্রকারভেদ (অ্যাকিউট বা ক্রনিক), এবং রোগীর সাধারণ স্বাস্থ্যের ওপর। এই রোগের চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হলো অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ কমানো, ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা, এবং যেসব কারণ এই সমস্যার জন্য দায়ী, সেগুলোর সমাধান করা।

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা:

হাসপাতালে ভর্তি এবং পর্যবেক্ষণ: অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যদি লক্ষণগুলো গুরুতর হয়। এখানে কিছু সাধারণ চিকিৎসার পদ্ধতি রয়েছে:

ইনট্রাভেনাস (IV) তরল ও ইলেক্ট্রোলাইট প্রদান: অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের সময় শরীর পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে, তাই রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে এবং পানিশূন্যতা রোধ করতে IV তরল দেওয়া হয়।

খাবার থেকে বিরতি (নিল বাই মাউথ): কিছুদিন রোগীকে কোনো খাবার না খেতে দেওয়া হয় (নিল বাই মাউথ), যাতে অগ্ন্যাশয় বিশ্রাম নিতে পারে এবং প্রদাহ কমতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে তরল ও হালকা খাবার শুরু করা হয়।

ব্যথা নিয়ন্ত্রণ: ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। ব্যথা তীব্র হলে শক্তিশালী পেইনকিলার দেওয়া হতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক: যদি সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে বা সংক্রমণ দেখা দেয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।

অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা: গলব্লাডারের পাথর, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, অথবা উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইডের মতো কারণগুলো চিকিৎসা করা হয়।

গলব্লাডারের পাথর অপসারণ: প্রয়োজনে এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলাঞ্জিওপ্যাঙ্ক্রিওগ্রাফি (ERCP) নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গলব্লাডারের পাথর অপসারণ করা হয়।

অ্যালকোহল নিরাময় প্রোগ্রাম: অ্যালকোহল-সংক্রান্ত প্যানক্রিয়াটাইটিসের জন্য অ্যালকোহল ছাড়ার প্রোগ্রামও প্রয়োজন হতে পারে।

আরো পড়ুন: কি খেলে ইউরিক এসিড বাড়ে । ইউরিক এসিড কমানোর ব্যায়াম।

যদি অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের জটিলতা, যেমন প্যানক্রিয়াটিক নেক্রোসিস (অগ্ন্যাশয়ের টিস্যুর মৃত্যু), দেখা দেয়, তবে সার্জারি বা অন্য বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী এবং এটি সাধারণত অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতি সীমিত রাখতে এবং রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে ফোকাস করে। এর মধ্যে রয়েছে:

ডায়েটারি পরিবর্তন: কম চর্বিযুক্ত এবং সহজপাচ্য খাবার খাওয়া। এছাড়া খাদ্য হজমে সহায়ক এনজাইম থেরাপি দেওয়া হয়।

অগ্ন্যাশয়ের এনজাইম সম্পূরক: ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণে অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত পরিমাণ এনজাইম তৈরি করতে না পারলে খাবার হজমে সমস্যা হতে পারে। তাই প্যানক্রিয়াটিক এনজাইম ট্যাবলেট দেওয়া হয়, যা খাদ্য হজমে সহায়তা করে।

ব্যথা নিয়ন্ত্রণ: ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে পেইন ম্যানেজমেন্টে ব্যথানাশক ওষুধ, কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক ব্যথা কমানোর ওষুধও ব্যবহার করা হয়।

ইনসুলিন থেরাপি: যদি অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং ডায়াবেটিস তৈরি হয়, তাহলে ইনসুলিন থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।

অ্যালকোহল ও ধূমপান বর্জন: ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে অ্যালকোহল এবং ধূমপান ত্যাগ করতে হয়, কারণ এই অভ্যাসগুলো প্যানক্রিয়াসের ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দেয়।

সার্জারি: দীর্ঘস্থায়ী বা জটিল ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় বা গলব্লাডারের কিছু অংশ অপসারণের জন্য সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।

প্যানক্রিয়াটিক ড্রেনেজ: যদি অগ্ন্যাশয়ে পাথর বা তরল জমে থাকে, তবে তা ড্রেন করার জন্য সার্জারি করা হতে পারে।

জটিলতার চিকিৎসা:

প্যানক্রিয়াটাইটিসের জটিলতা, যেমন কিস্ট (পসুডোসিস্ট) বা সংক্রমণ দেখা দিলে সেগুলোর জন্য আলাদা চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিস্ট ড্রেন করার জন্য এন্ডোস্কোপিক পদ্ধতি বা সার্জারি করা যেতে পারে।

লাইফস্টাইল পরিবর্তন ও পুনর্বাসন:

পুষ্টিবিদ বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ: সঠিক খাবার বেছে নেওয়া, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং হজম সহায়ক ওষুধ গ্রহণের জন্য পুষ্টিবিদের সাহায্য নেওয়া জরুরি।

অ্যালকোহল নিরাময় প্রোগ্রাম: যারা অ্যালকোহল-সংক্রান্ত প্যানক্রিয়াটাইটিসে ভুগছেন, তাদের জন্য অ্যালকোহল ত্যাগ করতে সাহায্য করার প্রোগ্রাম বা কাউন্সেলিং জরুরি।

প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসায় দ্রুত ব্যথা নিয়ন্ত্রণ, অগ্ন্যাশয়কে বিশ্রাম দেওয়া, এবং সমস্যার মূল কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদী বা ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং নির্দিষ্ট থেরাপি রোগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্যানক্রিয়াটাইটিস এর ঔষধসমূহ

প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো প্রধানত লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যথা উপশম, অগ্ন্যাশয়ের সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখা, এবং জটিলতা প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়। ওষুধের ধরন নির্ভর করে রোগীর অবস্থা, প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রকারভেদ (অ্যাকিউট বা ক্রনিক), এবং অন্যান্য সম্পর্কিত সমস্যার ওপর। নিচে কিছু সাধারণ ওষুধের তালিকা দেওয়া হলো:

ব্যথানাশক (Pain Relievers):

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস: তীব্র ব্যথা থাকলে হালকা থেকে মাঝারি ব্যথানাশক যেমন প্যারাসিটামল (Paracetamol), ইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) দেওয়া হয়। গুরুতর ব্যথার জন্য মরফিন (Morphine), হাইড্রোমরফোন (Hydromorphone) বা ফেন্টানিল (Fentanyl) মতো শক্তিশালী অপিওড ব্যথানাশক ব্যবহার করা হতে পারে।

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস: দীর্ঘমেয়াদী ব্যথার জন্য কম শক্তিশালী ব্যথানাশক, যেমন অ্যাসিটামিনোফেন (Acetaminophen) বা ট্রামাডল (Tramadol) দেওয়া হয়। ব্যথা খুব তীব্র হলে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থাপনার জন্য আরও শক্তিশালী ব্যথানাশক প্রয়োজন হতে পারে।

অগ্ন্যাশয়ের এনজাইম রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ( PERT): ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণে অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত পরিমাণ এনজাইম তৈরি করতে ব্যর্থ হলে প্যানক্রিয়াটিক এনজাইম সম্পূরক দেওয়া হয়, যা খাদ্য হজমে সহায়তা করে। সাধারণ ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে: ক্রেয়ন (Creon), প্যানক্রিয়েজ (Pancreaze), জেনপেপ (Zenpep) এই ওষুধগুলোতে এনজাইম (লিপেজ, প্রোটেজ, অ্যামাইলেজ) থাকে, যা চর্বি, প্রোটিন ও শর্করা হজম করতে সাহায্য করে।

অ্যান্টিবায়োটিক: যদি প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে বা প্যানক্রিয়াসে সংক্রমণ ঘটে, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। যেমন: সিপ্রোফ্লোক্সাসিন (Ciprofloxacin), মেট্রোনিডাজল (Metronidazole), পাইপেরাসিলিন/ট্যাজোব্যাকটাম (Piperacillin/Tazobactam)

অ্যান্টি-সিক্রেটরি ড্রাগস: এই ওষুধগুলো অগ্ন্যাশয়ের রস নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করে, যা প্যানক্রিয়াসকে বিশ্রাম দেয়। সাধারণত এন্ডোস্কোপিক সাপোর্ট বা সার্জারির আগে বা পরে দেওয়া হয়। উদাহরণ: অকট্রিওটাইড (Octreotide): এটি একটি সিনথেটিক হরমোন, যা অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং রস নিঃসরণ কমায়। সোমাটোস্টাটিন (Somatostatin): এটি অগ্ন্যাশয়ের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

প্যানক্রিয়াটাইটিস-এর-ঔষধসমূহ

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার (PPI): যাদের অ্যাসিডিটি সমস্যা রয়েছে বা অগ্ন্যাশয়ের সমস্যা থেকে এড়াতে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাদের জন্য প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার (PPI) ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ: ওমিপ্রাজল (Omeprazole), এসমিপ্রাজল (Esomeprazole), ল্যান্সোপ্রাজল (Lansoprazole).

ইনসুলিন থেরাপি: ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে অক্ষম হলে বা ডায়াবেটিস দেখা দিলে রোগীদের ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়।

অ্যান্টিহিস্টামিন ও অ্যান্টিএমেটিক: বমি বমি ভাব এবং বমি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের সময়। যেমন: মেটোক্লোপ্রামাইড (Metoclopramide), ওন্দানসেট্রন (Ondansetron).

ভিটামিন এবং পুষ্টি সম্পূরক: ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণে পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে। এজন্য বিভিন্ন ভিটামিন (বিশেষ করে A, D, E, K) এবং খনিজ সম্পূরক নেওয়া হয়।

অ্যালকোহল নিরাময় ওষুধ: যদি প্যানক্রিয়াটাইটিস অ্যালকোহলজনিত হয়, তবে অ্যালকোহল ত্যাগে সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ, যেমন ডিসালফিরাম (Disulfiram) ব্যবহার করা হতে পারে।

প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের মধ্যে রয়েছে ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য পেইন রিলিভার, অগ্ন্যাশয়ের সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে এনজাইম রিপ্লেসমেন্ট, সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, এবং অন্যান্য সহায়ক থেরাপি। চিকিৎসা শুরু করার আগে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা ভিন্ন হতে পারে।

প্যানক্রিয়াস ভালো রাখার ব্যায়াম

প্যানক্রিয়াসের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং এর কার্যকারিতা বজায় রাখতে সঠিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি কিছু ব্যায়ামও সহায়ক হতে পারে। যদিও ব্যায়াম সরাসরি প্যানক্রিয়াসকে সুস্থ রাখে না, তবে সেগুলো শরীরের মেটাবলিজম এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে। এভাবে প্যানক্রিয়াসের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদে ভালো থাকে।

হালকা এরোবিক ব্যায়াম: এরোবিক ব্যায়াম শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার স্তর নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, যা প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ কমায়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

  • হাঁটাহাঁটি: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হালকা হাঁটা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
  • জগিং বা দৌড়ানো: নিয়মিত হালকা দৌড় প্যানক্রিয়াসের কার্যকারিতা ভালো রাখে।
  • সাইক্লিং: বাইসাইকেল চালানো বা ঘরে স্টেশনারি বাইকে প্যাডেল চালানোও উপকারী।
  • সাঁতার: সাঁতার একটি পুরো শরীরের ব্যায়াম, যা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা ভালো রাখে এবং রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে।

যোগব্যায়াম (Yoga): যোগব্যায়াম মানসিক এবং শারীরিক ভারসাম্য বজায় রেখে প্যানক্রিয়াসের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট আসন প্যানক্রিয়াসের কার্যকারিতা উন্নত করে, যেমন:

  • ভুজঙ্গাসন (Bhujangasana - Cobra Pose): এই আসন প্যানক্রিয়াসে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
  • পশ্চিমোত্তানাসন (Paschimottanasana - Seated Forward Bend): এই আসন অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোতে সঞ্চালন উন্নত করে এবং অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
  • ধনুরাসন (Dhanurasana - Bow Pose): এটি প্যানক্রিয়াসে চাপ প্রয়োগ করে এবং হজমশক্তি উন্নত করে।
  • কপালভাতি (Kapalbhati Pranayama): এটি পেটের গভীর শ্বাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং অগ্ন্যাশয়ের সঠিক কার্যকারিতার জন্য সহায়ক।

রেজিস্ট্যান্স ও স্ট্রেন্থ ট্রেনিং: শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম, যেমন: ফ্রি ওয়েট লিফটিং বা বডিওয়েট এক্সারসাইজ (পুশ-আপস, স্কোয়াট) করতে পারেন, যা শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে। এটি শরীরের মেটাবলিজমকে উন্নত করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যা প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ কমায়।

তাই চি (Tai Chi): তাই চি একটি ধীর গতির, মৃদু ব্যায়াম পদ্ধতি, যা শরীর এবং মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এটি সঠিক রক্তসঞ্চালন বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর স্বাস্থ্য উন্নত করে।

ব্রিদিং এক্সারসাইজ: সঠিক শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম (যেমন প্রণায়াম) শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর সঠিক কার্যকারিতা উন্নত করে। শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, যা প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

ওজন নিয়ন্ত্রণের ব্যায়াম: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্যানক্রিয়াসের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা প্যানক্রিয়াসের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং প্যানক্রিয়াসের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। সেজন্য: নিয়মিত ব্যায়াম ও সুষম খাদ্যাভ্যাস ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।

লেখকের মতামত: প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয়

প্যানক্রিয়াটাইটিস একটি মারাত্মক রোগ। তবে সুষম খাদ্য, পরিমিত খাবার, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলা ইত্যাদির মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। নিয়মিত হালকা এরোবিক ব্যায়াম, যোগব্যায়াম, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম প্যানক্রিয়াসের কার্যকারিতা ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারে। এসব ব্যায়াম শরীরের মেটাবলিজম উন্নত করে, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ কমায়, যা দীর্ঘমেয়াদে অগ্ন্যাশয় সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আমাদের আজকের আর্টিকেল সম্পর্কে কোন মতামত বা পরামর্শ থাকলে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url