ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল এর আশ্চর্যজনক উপকারিতা ও এর ব্যবহার

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল কি এবং এই তেল কি কাজে আসে আমরা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এটা জানতে চাই। যারা ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল সম্পর্কে জানতে চান আমাদের আজকের আর্টিকেলটি তাদের জন্য।

ভেন্নার-তেল-বা-ক্যাস্টার-অয়েল

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল মূলত একটি উদ্ভিজ্জ তেল। যা আমাদের অনেক কাজে লাগে। আমাদের আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনার ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন বলে আমরা আশা রাখি।

সূচীপত্র

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল কি

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল হলো একটি উদ্ভিজ্জ তেল যা মূলত ভেন্না বীজ বা ক্যাস্টার বীজ থেকে উৎপন্ন হয়। এই তেলটি বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর এবং ঔষধি গুণাবলীর জন্য পরিচিত। ভেন্না গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ricinus communis। এটি Euphorbiaceae পরিবার গোত্রীয় গাছ। এই গাছ মূলত পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারতে পাওয়া যায়। ভেন্নার তেলে প্রধানত রাইসিনোলেইক অ্যাসিড (Ricinoleic acid) থাকে যা এর প্রধান কার্যকরী উপাদান। হালকা কালচে রঙের এই তেল মূলত রিসিনাস কমিউনিস্ট প্রজাতির উদ্ভিদের বীজ থেকে নিষ্কাশন এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এর মধ্যে বিষাক্ত এনজাইম রেসিন থাকে যা ব্যবহার করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই হিটিং প্রসেসের মাধ্যমে এর বিষাক্ত প্রভাব কে ধ্বংস করে তবেই তাকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয় । 

আরো পড়ুন: লাল আঙুর ফলের অজানা আশ্চর্যজনক পুষ্টিগুন ও উপকারিতা।

ক্রান্তীয় আবহাওয়া সম্পন্ন এলাকা যেমন আফ্রিকা এবং ভারতে এই তেল বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত এই তেল শুধুমাত্র দৈনন্দিক কাজে নয় প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতেও বহুল ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন ভাষায় এই তেলকে নানা নামে ডাকা হয় যেমন- আরান্ডি কা তেল (হিন্দি), আমুদামু (তেলেগু), এরান্ডলা তেলা (মারাঠী), আমানাক্ক এনি (তামিল), রেড়ির তেল (বাঙলা)। রেড়ির তেল একটি অতি সাধারণ এবং প্রাকৃতিক গুণসম্পন্ন ভেষজ তেল যা দৈনন্দিন নানান কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্য সম্মৃদ্ধ এই প্রাকৃতিক উপকরণে আছে অ্যান্টিইনফ্লামেটরি এবং অ্যান্টিব্যকটেরিয়াল গুণাগুণ। এই তেলটি সাধারণত বর্ণহীন থেকে ফ্যাকাশে হলুদ রঙের হয় এবং এর গন্ধ কিছুটা তিক্ত।

ভেন্না বা ক্যাস্টারের গাছ পরিচিতি

সবচেয়ে বড় পাতা জাতের উদ্ভিদগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ভেন্না গাছ। গাছগুলো আট থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। গজানোর সময় কোনো শাখা-প্রশাখা থাকে না। একটু বড় হলে শাখা-প্রশাখায় চারদিক ছড়িয়ে যায়।ভেন্না বিনা চাষেই বর্ষাকালে গজায় এবং হেমন্ত ও শীতকালে ফুল ও ফল ধরা শুরু করে। অনুকূল পরিবেশ পেলে সারা বছরই ফল ধরে। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বোম্বাই ও স্থানীয় জাতের ভেন্নাই আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। গাছগুলো সাদা ও লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। গিটাযুক্ত গাছের পাতায় আট-দশটি কোনাযুক্ত পাতা মানুষের হাতের মতো ছড়ানো থাকে। পাতাগুলো ছয় থেকে আট ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের বয়স দুই থেকে তিন মাস হলে শাখায় শাখায় ফুলের কাঁদি হয়। প্রতিটি কাঁদিতে দেড় থেকে দুই শতাধিক পর্যন্ত ফল ধরে। প্রত্যেক ফলে তিন-চারটি বীজ দানা হয়। কিছু দিন পর কাঁদিগুলো পাক ধরলে হাল্কা কালচে বর্ণের হয়। তখন গাছ থেকে কাঁদিসহ ফল ছাড়িয়ে নিয়ে রোদে শুকিয়ে বীজ সংগ্রহ করা হয়।

ভেন্না বা ক্যাস্টারের চাষাবাদ

ভেন্না গাছের চাষাবাদ সহজ এবং কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত এবং পদ্ধতি মেনে চললে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ভেন্না গাছের জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। মাটি হতে হবে ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং উর্বর। উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া ভেন্না গাছের জন্য ভালো। ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সর্বোত্তম।

বীজ রোপণ এর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর এবং রোগমুক্ত বীজ নির্বাচন করতে হবে। বীজগুলো ২-৩ সেমি গভীরে এবং প্রায় ৬০-৯০ সেমি দূরত্বে রোপণ করুন। বীজ বপনের পর প্রথমে হালকা সেচ দিতে হবে। তারপর নিয়মিত সেচ দেওয়া প্রয়োজন। প্রতি ২-৩ মাস অন্তর জৈব সার প্রয়োগ করুন। আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। পোকামাকড় এবং রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন, যেমন প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার। ফুল ফোটার ৯০-১৫০ দিন পরে বীজ সংগ্রহ করা হয়। বীজ সংগ্রহের পর রোদে শুকিয়ে তেল নিষ্কাশনের জন্য প্রস্তুত করতে হয়।

ভেন্না বা ক্যাস্টার অয়েল তৈরির প্রক্রিয়া

ক্যাস্টার অয়েল তৈরির প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে। এখানে প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

ক্যাস্টার অয়েল তৈরির প্রথম ধাপ হলো রিসাস (castor) বীজ সংগ্রহ করা। সাধারণত, ভেন্না বা ক্যাস্টার গাছের পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। এরপর সংগ্রহিত বীজগুলো পরিষ্কার করতে হবে। ময়লা, ধূলা এবং অন্য কোনো অমেধ্য দূর করতে বীজগুলো ধুয়ে এবং শুকিয়ে নিতে হবে। পরিষ্কার করা বীজগুলো একটি পেষণ যন্ত্রে পেষণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বীজের তেল বের হয়ে আসে। তেল এবং অন্যান্য উপাদান আলাদা করতে একটি ফিল্টার ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিক পেষণ প্রক্রিয়ার পরে, তেলটি ফিল্টার করা হয় যাতে ময়লা এবং অন্যান্য কঠিন পদার্থ দূর হয়। ফিল্টার করা তেলটিকে স্টোরেজ ট্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। 

আরো পড়ুন: এক সপ্তাহে পেটের মেদ বা চর্বি কমান ৭ টি উপায়ে।

প্রাথমিক ফিল্টার করার পর তেলটি আরও পরিশোধনের জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় তেলের রঙ এবং গন্ধ উন্নত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড বা সালফিউরিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়। তেলটির স্থায়িত্ব এবং গুণগত মান নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তেলটি প্রক্রিয়া করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় তেলের আর্দ্রতা এবং অন্যান্য অমেধ্য দূর করা হয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পর তেলটি আরও একবার ফিল্টার করা হয়। এরপর তেলটি বোতলজাত করে বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়।

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েলের উপকারিতা

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল একটি বহুমুখী তেল যা স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য এবং ঘরোয়া চিকিৎসার জন্য বহুল ব্যবহৃত হয়। নিচে ভেন্নার তেলের উল্লেখযোগ্য কিছু উপকারিতা উল্লেখ করা হলো:

ত্বকের যত্ন: ভেন্নার তেল ত্বককে মসৃণ এবং কোমল রাখতে সাহায্য করে। শুষ্ক ত্বক ময়শ্চারাইজ করতে কার্যকরী।

ভেন্নার-তেল-বা-ক্যাস্টার-অয়েল-উপকারিতা

ব্রণ নিরাময়: এর অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য ব্রণ এবং ত্বকের অন্যান্য সমস্যার নিরাময়ে সহায়ক।

চুলের যত্ন: চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে। চুলের গোড়া মজবুত করতে এবং খুশকি দূর করতে ব্যবহৃত হয়। চুলকে লম্বা, ঘন করতে এবং তার প্রাকৃতিক উজ্বলতা বজায় রাখতে নিয়মিতভাবে ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে মাথায় ম্যাসাজ করলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়

কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়: প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ হিসেবে ভেন্নার তেল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক।

যকৃতের স্বাস্থ্য: যকৃতের বিষমুক্তি করতে এবং যকৃতের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

প্রদাহ উপশম: আথ্রাইটিস, গাঁটে ব্যথা, এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত রোগের উপশমে কার্যকরী।

ঘা এবং ক্ষত নিরাময়: পোকামাকড়ের কামড়, ক্ষত বা পোড়া স্থানে ভেন্নার তেল প্রয়োগ করলে দ্রুত নিরাময় হয়।

প্রাকৃতিক মেকআপ রিমুভার: ভেন্নার তেল মেকআপ রিমুভার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি ত্বককে পরিষ্কার এবং ময়শ্চারাইজ করে।

ফাটা পা নিরাময়: ফাটা পায়ের যত্নে ভেন্নার তেল ব্যবহার করা হয়। এটি ত্বককে নরম এবং মসৃণ রাখতে সহায়ক।

ইমিউন সিস্টেম বৃদ্ধিতে সহায়ক: ভেন্নার তেল ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, যা শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল ব্যবহারের অপকারিতা

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল উপকারী হিসেবেই বেশি পরিচিত। তবে এর কিছু অপকারিতা আছে যা ব্যবহারের আগে জানা জরুরি। নিচে কিছু প্রধান অপকারিতা উল্লেখ করা হলো:

১. এলার্জি বা ত্বকের প্রদাহ: কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভেন্নার তেল ব্যবহার করলে ত্বকের প্রদাহ, লালচে ভাব, বা চুলকানি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের ফুসকুড়ি, বা চোখের ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।

২. পেটের সমস্যা: ভেন্নার তেল প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ হওয়ায় অতিরিক্ত সেবনে ডায়রিয়া বা পেট খারাপ হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে তেল সেবন করলে পেটে মচকানো বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে।

৩. গর্ভাবস্থায় সতর্কতা: গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ভেন্নার তেল সেবন নিরাপদ নয়। এটি গর্ভাশয়ে সংকোচন ঘটাতে পারে, যা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. ত্বকের সমস্যা: কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভেন্নার তেল ব্যবহারে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যাদের ত্বক স্বাভাবিকের থেকে শুষ্ক। ভেন্নার তেল কিছু মানুষের ত্বকে ব্রণ বা একনে সৃষ্টি করতে পারে।

৫. অতিরিক্ত ব্যবহারে সমস্যা: অতিরিক্ত ভেন্নার তেল ব্যবহার করলে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল ব্যালান্স নষ্ট হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ভেন্নার-তেল-বা-ক্যাস্টার-অয়েল-অপকারিতা

৬. অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ভেন্নার তেল ব্যবহারের ফলে কিছু ক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, বমি ভাব, এবং হালকা মাথা ব্যথা হতে পারে।

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল ব্যবহারে সতর্কতা ও পরামর্শ

প্রথমবার ব্যবহারের আগে ত্বকের একটি ছোট্ট স্থানে তেল প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা উচিত, যাতে এলার্জি বা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অতিরিক্ত সেবন বা ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মহিলাদের জন্য ভেন্নার তেল সেবন নিরাপদ নয়।

লেখকের মতামত

ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল একটি প্রাকৃতিক তেল যা ত্বক, চুল, এবং স্বাস্থ্যের জন্য নানাভাবে উপকারী। তবে এটির সঠিক ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। গর্ভবতী মহিলার এটি ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। আমাদের আর্টিকেল সম্পর্কে কোন মতামত বা পরামর্শ থাকলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ।

আরো পড়ুন: বাসক পাতার ঔষধি গুনাগুন | বাসক পাতা খাওয়ার নিয়ম।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url