আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা সম্পর্কে আপনি কি জানতে চাচ্ছেন? তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। আপেল সিডার ভিনেগারের অনেক উপকারিতা রয়েছে। সেগুলো জানতে আমাদের পুরো আর্টিকেলটি পড়ুন।
আমাদের আজকের আর্টিকেলটি পড়লে আপনি আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারবেন। তার সাথে এর উৎপাদন, পুষ্টিগুন, অপকারিতা ও ব্যবহারের সতর্কতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
পোস্ট সূচীপত্র: আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা
আপেল সিডার ভিনেগার পরিচিতি
আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা জানার আগে জানতে হবে আপেল সিডার ভিনেগার কি? আপেল সিডার ভিনেগার হল আপেল থেকে তৈরি এক ধরনের ভিনেগার। এটি আপেলকে চূর্ণ করে এবং তারপর তা থেকে রস বের করে গাঁজনের প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়। আপেলের রস প্রথমে শর্করা থেকে অ্যালকোহলে পরিণত হয়, এরপর তা আরও গাঁজনের মাধ্যমে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়, যা ভিনেগারকে তার টক স্বাদ দেয়।
ভিনেগার শব্দটি ফরাসি থেকে এসেছে । এর অর্থ "টক ওয়াইন" বা টক স্বাদযুক্ত ওয়াইন। সহজ কথায়, আপেল সিডার ভিনেগার হল ফার্মেন্টেড জুস। এটি আপেল কেটে প্রাপ্ত রস থেকে তৈরি করা হয়। অ্যালকোহলযুক্ত গাঁজন প্রক্রিয়াটি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। আপেলের চিনি ভেঙ্গে অ্যালকোহলে পরিণত হয়। এরপর অ্যালকোহল ভিনেগারকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে (ব্যাকটেরিয়া যেমন অ্যাসিটোব্যাক্টর) রূপান্তরিত করে। অ্যাসিটিক এবং ম্যালিক অ্যাসিড ভিনেগারকে এর বিখ্যাত স্বাদ দেয়।
আপেল সিডার ভিনেগার যেভাবে প্রস্তুত করা হয়
আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা পেতে হলে এক যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হবে। আপেল সিডার ভিনেগার তৈরির প্রক্রিয়া সাধারণত গাঁজনের দুটি ধাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ, তবে সময়সাপেক্ষ। নিচে এর ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো:
আপেলের রস তৈরি: প্রথমে তাজা এবং পাকা আপেল সংগ্রহ করতে হবে। যে কোনো প্রকার আপেল ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মিষ্টি এবং টক আপেলের মিশ্রণ ভালো ফল দেয়। তারপর আপেলগুলো ছোট টুকরো করে কেটে বা মিহি করে চূর্ণ করে রস বের করতে হবে। আপেলের খোসা এবং বীজসহ রস বের করা যেতে পারে। চূর্ণ করা আপেলগুলো একটি কাপড়ের মাধ্যমে চেপে বা প্রেস করে রস বের করতে হবে। এই রসই আপেল সিডার ভিনেগার তৈরির প্রথম ধাপ।
আরো পড়ুন: গর্ভাবস্থায় কচু শাক খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা।
প্রাথমিক গাঁজন : আপেল থেকে বের করা রস একটি পরিষ্কার কাচের বা সিরামিকের পাত্রে ঢালা হয়। এই পাত্রটি ঢেকে রাখতে হবে তবে কিছুটা বায়ুপ্রবাহ থাকতে হবে যাতে প্রাকৃতিক খামির বায়ু থেকে রসে প্রবেশ করতে পারে। গাঁজনের সময় আপেলের রসের মধ্যে উপস্থিত শর্করা খামিরের প্রভাবে অ্যালকোহলে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়া প্রায় ৩-৪ সপ্তাহ সময় নিতে পারে। এই সময় পাত্রটি একটি অন্ধকার এবং উষ্ণ স্থানে রাখতে হবে।
দ্বিতীয় গাঁজন : যখন আপেলের রস থেকে অ্যালকোহল তৈরি হয়ে যায়, তখন ব্যাকটেরিয়া সেই অ্যালকোহলকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে পরিণত করে। এই প্রক্রিয়ায় রসের স্বাদ ভিনেগারের মতো টক হয়ে ওঠে। এই ধাপে সাধারণত আরও ৩-৪ সপ্তাহ সময় লাগে। গাঁজনের সময় পাত্রের উপরিভাগে "মাদার" নামে পরিচিত একটি ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ তৈরি হতে পারে, যা আপেল সিডার ভিনেগারের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
ফিল্টারিং এবং বোতলজাতকরণ: যারা মাদার ছাড়া পরিস্কার আপেল সিডার ভিনেগার চান, তারা ভিনেগার ফিল্টার করতে পারেন। তবে অপরিশোধিত ভিনেগারে মাদার রেখে দেওয়াই বেশি স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয়। প্রক্রিয়া শেষে ভিনেগারটি পরিষ্কার কাচের বোতলে ঢেলে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি শীতল এবং অন্ধকার স্থানে রেখে কয়েক মাস বা বছরের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এই সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আপনি সহজেই ঘরে বসে আপেল সিডার ভিনেগার তৈরি করতে পারেন।
আপেল সিডার ভিনেগারের পুষ্টিগুন
আপেল সিডার ভিনেগার একটি লো-ক্যালোরি পণ্য, যা বিভিন্ন পুষ্টিগুণ ধারণ করে। যদিও এটি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং মিনারেল সরবরাহ করে না, তবে এতে কিছু পরিমাণে পুষ্টি উপাদান এবং অন্যান্য উপকারী যৌগ থাকে। এই পুষ্টিগুন গুলো আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিচে আপেল সিডার ভিনেগারের পুষ্টিগুণ ও অন্যান্য উপাদানগুলোর তালিকা এবং পরিমাণ দেওয়া হলো (প্রতি ১ টেবিল চামচ বা প্রায় ১৫ মিলিলিটার হিসেবে):
- ক্যালোরি: 3 ক্যালোরি
- কার্বোহাইড্রেট: 0.1 গ্রাম (প্রধানত শর্করা)
- প্রোটিন: 0 গ্রাম
- চর্বি: 0 গ্রাম
- আঁশ: 0 গ্রাম
- ভিটামিন ও মিনারেল:
- পটাসিয়াম: 11 মিলিগ্রাম (প্রতিদিনের প্রয়োজনের প্রায় 0.2%)
- ক্যালসিয়াম: সামান্য পরিমাণ
- ম্যাগনেসিয়াম: সামান্য পরিমাণ
- ফসফরাস: সামান্য পরিমাণ
অ্যাসিটিক অ্যাসিড: আপেল সিডার ভিনেগারের প্রধান সক্রিয় উপাদান, যা এতে প্রায় ৫-৬% পরিমাণে থাকে। এটি ভিনেগারের টক স্বাদ এবং গন্ধের জন্য দায়ী এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করতে পারে, যেমন রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রভাব।
আরো পড়ুন: গর্ভাবস্থায় চেরি ফল: চেরি ফল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: আপেলের থেকে আসা কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়ক।
পলিফেনল: প্রাকৃতিক যৌগ, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করতে পারে এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করতে পারে।
অন্যন্য ট্রেস মিনারেলস: সামান্য পরিমাণে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, এবং অন্যান্য ট্রেস মিনারেলস থাকতে পারে।
আপেল সিডার ভিনেগারের উপকারিতা
আপেল সাইডার ভিনেগার আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায়ও এর বর্ণনা রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এটিকে ক্ষত নিরাময়কারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।। নিন্মে আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা তুলে ধরা হলো:
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : এটি টাইপ 2 ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস রোগীরা প্রতিদিন ঘুমানোর আগে 2 চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার খান তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা 4% পর্যন্ত কমাতে পারে। টাইপ 2 যাদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকে। এতে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। একটি সমীক্ষা অনুসারে, ভিনেগার টাইপ 2 ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রা উন্নত করতে সাহায্য করে। যাইহোক, ডায়াবেটিসের ওষুধের পাশাপাশি ভিনেগার গ্রহণ করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: আপেল সিডার ভিনেগারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর বিপাক ত্বরান্বিত করার ক্ষমতা। এর মানে হল যে আমরা যখন এটি খাই তখন আমাদের পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে। ফলস্বরূপ, মানুষ অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ এড়ায় এবং তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। তবে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনের জন্য এটি নিয়মিত 3 মাস ধরে নিতে হবে। কিছু গবেষণা অনুসারে, আপেল সিডার ভিনেগার পেটের চর্বি কমাতেও সাহায্য করতে পারে।
লিভার সুস্থ রাখতে ও বিষাক্ত পদার্থ দূরীকরণ: আপেল সিডার ভিনেগার লিভার ডিটক্সিফিকেশন বা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে। এটি লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করতে এবং শরীরের বিষাক্ত পদার্থগুলোকে অপসারণ করতে সহায়তা করতে পারে।
হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা: অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, আপেল সিডার ভিনেগার শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। একাধিক গবেষণায় এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। একই সময়ে, এটি মেয়েদের নিয়মিত মাসিক হতে সাহায্য করে।
হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে: এটি আপনার রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে পারে। রক্তচাপ এবং ট্রাইগ্লিসারাইডগুলিও কমাতে পারে। এটি স্বাভাবিকভাবেই হার্টের ক্ষতির ঝুঁকি কমায়। হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য, আপেল সিডার ভিনেগার প্রতিদিন খাওয়া উচিত। পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত সেবন হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ ও কার্যক্ষম রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
হজমশক্তি উন্নত করে: পাকস্থলীতে অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে। এটি আমাদের পাকস্থলীতে পেপসিন নামক এনজাইমের উৎপাদন বাড়ায়। পেপসিন দ্রুত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হজম করে, ফলে দ্রুত হজম হয়।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: সমস্ত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আপেল সিডার ভিনেগার ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে ভিনেগারে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে। তাই ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ প্রতিরোধে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এই ভিনেগার যোগ করা উচিত। এটি খাদ্যনালীর ক্যান্সার প্রতিরোধেও কার্যকর।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ: আপেল সিডার ভিনেগার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে এবং খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়ক হতে পারে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: মানুষের শরীরের কিডনি রেনিন নামক হরমোন তৈরি করে। এটি রক্তনালীগুলিকে সরু বা প্রশস্ত করতে পারে। আপেল সাইডার ভিনেগার রেনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রক্তনালীকে স্বাভাবিক রাখে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
সর্দি এবং ফ্লু: আপেল সাইডার ভিনেগার ঋতুকালীন সর্দি যেমন হাঁচি এবং গলা ব্যথার চিকিৎসায় খুবই উপকারী। আপনার সর্দি লাগলে অল্প পরিমাণে আপেল সিডার ভিনেগার গরম পানিতে মিশিয়ে গার্গল করতে সাহায্য করে।
ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া রোধে: আপেল সাইডার ভিনেগার ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া যেমন E. coli এর বিরুদ্ধে একটি বাধা তৈরি করে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন খাবার এতে মজুত করা হতো।
ত্বকের যত্নে: আপেল সিডার ভিনেগার প্রাকৃতিক টোনার হিসেবে ত্বকের পিএইচ স্তর ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং ব্রণের সমস্যা কমাতে সহায়ক। এটি ত্বকে প্রয়োগ করলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
চুলের যত্নে: আপেল সিডার ভিনেগার চুলের পিএইচ স্তর ভারসাম্য রক্ষা করে এবং খুশকি কমাতে সহায়ক। এটি চুল ধোয়ার পরে পানির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং চুলের ক্ষয় রোধ করতে পারে। চুল পড়ার সমস্যায় ভুগে থাকেন অনেকেই। অতিরিক্ত চুল পড়া চুল পাতলা হতে পারে। চুল পড়ার এই সমস্যা সমাধানে আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করতে পারেন। দুই চামচ ভিনেগার সামান্য পানিতে মিশিয়ে চুলের গোড়ায় ম্যাসাজ করলে চুল পড়ার সমস্যা কমে যায়।
প্রাকৃতিক ডিওডোরেন্ট: আপেল সিডার ভিনেগার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রভাবের কারণে ঘামের দুর্গন্ধ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এটি প্রাকৃতিক ডিওডোরেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: আপেল সিডার ভিনেগার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এটি শরীরের পিএইচ স্তর ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়ক হতে পারে।
আপেল সিডার ভিনেগারের ব্যবহার
আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা পেতে হলে অবশ্যই এটিকে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। আপেল সিডার ভিনেগার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, যা স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, রান্না, এবং গৃহস্থালী কাজে সহায়ক হতে পারে। নিচে এর কিছু সাধারণ ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
ওজন কমানোর জন্য: এক গ্লাস পানির সাথে ১-২ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে সকালে খালি পেটে বা খাবারের আগে পান করা যেতে পারে। এটি ক্ষুধা দমন করতে এবং বিপাক ক্রিয়া উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।
আরো পড়ুন: সকালে খালি পেটে কাঁচা পেঁপে খাওয়ার উপকারিতা।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে: খাবারের আগে বা পরে আপেল সিডার ভিনেগার পান করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত।
হজমের উন্নতির জন্য: খাবারের আগে ১ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার এক গ্লাস পানির সাথে মিশিয়ে পান করলে হজম প্রক্রিয়া উন্নত হতে পারে।
ত্বকের যত্নে: আপেল সিডার ভিনেগার টোনার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এক অংশ আপেল সিডার ভিনেগার এবং দুই অংশ পানি মিশিয়ে ত্বকে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি ত্বকের পিএইচ স্তর ভারসাম্য রাখতে এবং ব্রণ কমাতে সহায়ক।
চুলের যত্নে: চুল ধোয়ার পরে আপেল সিডার ভিনেগার ও পানির মিশ্রণ (১:৩ অনুপাতে) দিয়ে চুলে লাগিয়ে ৫-১০ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলতে পারেন। এটি চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং খুশকি কমাতে সাহায্য করবে।
গলা ব্যথা উপশমে: এক কাপ গরম পানিতে ১-২ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে গার্গল করলে গলা ব্যথা বা টনসিলাইটিস কমাতে সহায়ক হতে পারে।
সালাদ ড্রেসিং: আপেল সিডার ভিনেগার সরাসরি সালাদ ড্রেসিংয়ে ব্যবহার করা যায়। এটি সালাদের স্বাদ বাড়াতে এবং টক-মিষ্টি মিশ্রণ তৈরি করতে সাহায্য করে।
ম্যারিনেড: মাংস বা শাকসবজির ম্যারিনেড হিসেবে আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি খাবারের টেক্সচার নরম করতে এবং স্বাদ উন্নত করতে সাহায্য করে।
সস এবং চাটনিতে: বিভিন্ন সস এবং চাটনিতে স্বাদ বাড়াতে আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রাকৃতিক ক্লিনার: আপেল সিডার ভিনেগার এবং পানির মিশ্রণ (১:১ অনুপাতে) ব্যবহার করে কিচেনের কাউন্টার, জানালা, এবং অন্যান্য পৃষ্ঠ পরিষ্কার করা যায়। এটি প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক হিসেবেও কাজ করে।
প্রাকৃতিক ডিওডোরেন্ট: ঘামের গন্ধ কমানোর জন্য আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পায়ের গন্ধ কমাতেও সাহায্য করতে পারে।
ফ্রুট এবং ভেজিটেবল ওয়াশ: আপেল সিডার ভিনেগার এবং পানি মিশিয়ে ফল ও সবজি ধোয়া যেতে পারে। এটি তাদের থেকে ময়লা এবং কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করতে সাহায্য করবে।
অম্লতা ও গ্যাসের জন্য: ১ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খেলে পেটের গ্যাস ও অম্লতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম
আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা পেতে গেলে খাওয়ার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খেতে হবে। তাহলে এটি থেকে স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব। নিচে আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার সাধারণ নিয়মগুলো দেওয়া হলো:
পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া: সাধারণত ১-২ টেবিল চামচ (১৫-৩০ মিলিলিটার) আপেল সিডার ভিনেগার এক গ্লাস (প্রায় ৮ আউন্স) পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়। এটি দিনে ১-৩ বার খাওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে খাবারের আগে। তবে দিনে ৩০ মিলিলিটারের বেশি না খাওয়াই ভালো।
খালি পেটে খাওয়া: সকালে খালি পেটে আপেল সিডার ভিনেগার পান করলে এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে খালি পেটে খাওয়ার সময় এটি পানির সাথে সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে খেতে হবে, যেন অম্লতা বা পেটের সমস্যা না হয়।
আরো পড়ুন: রূপচর্চায় পুদিনা পাতার ব্যবহার। পুদিনা পাতার উপকারিতা।
খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া: খাবারের সাথে আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি সালাদ ড্রেসিং, সস, বা ম্যারিনেডে ব্যবহার করে খাওয়া যেতে পারে।
মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়া: অনেকেই আপেল সিডার ভিনেগার পান করার সময় এর টক স্বাদ কমানোর জন্য মধু মিশিয়ে খেয়ে থাকেন। এক গ্লাস পানির সাথে ১ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার এবং ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য: খাবারের আগে ১ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার পান করতে পারেন। এটি খাবার থেকে গ্লুকোজের শোষণ ধীর করতে সাহায্য করতে পারে।
ওজন কমানোর জন্য: প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার পান করলে ক্ষুধা কমে এবং ওজন কমতে সাহায্য করতে পারে।
সঠিকভাবে পান করার নিয়ম: অনেকেই খাবারের আগে বা পরে এটি পান করেন, যা হজমে সহায়ক হতে পারে। তবে, খাওয়ার ঠিক পরপর এটি পান করলে কিছু মানুষের গ্যাস্ট্রিক বা অম্লতা হতে পারে, তাই খাবারের পর ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করে পান করা ভালো।
খাওয়ার পর ভালোভাবে মুখ ধুয়ে ফেলুন: আপেল সিডার ভিনেগারে অ্যাসিড থাকে, যা দাঁতের এনামেলের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই এটি খাওয়ার পর মুখ ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
আপেল সিডার ভিনেগার এর অপকারিতা
আপেল সিডার ভিনেগারের কার্যকরী উপকারিতা যদিও যথেষ্ট পরিমানে রয়েছে, তবে এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। বিশেষ করে যদি এটি অতিরিক্ত বা সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হয়। নিচে আপেল সিডার ভিনেগারের কিছু সম্ভাব্য অপকারিতা উল্লেখ করা হলো:
দাঁতের এনামেল ক্ষয়: আপেল সিডার ভিনেগার উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিক হওয়ায় এটি দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে, ফলে দাঁত সংবেদনশীল হয়ে পড়তে পারে এবং দাঁতে গর্ত (cavity) তৈরি হতে পারে। এটি প্রতিরোধের জন্য আপেল সিডার ভিনেগার পান করার পর মুখ ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং এটি সরাসরি পান না করে পানির সাথে মিশিয়ে পান করতে হবে।
পেটের অম্লতা এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যা: অতিরিক্ত আপেল সিডার ভিনেগার খেলে পেটে অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপন্ন হতে পারে, যা গ্যাস্ট্রিক, অম্লতা, এবং পেটে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সীমিত পরিমাণে এবং খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিত।
ইসোফেগাসে জ্বালা: আপেল সিডার ভিনেগারের অ্যাসিড ইসোফেগাসে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি খালি পেটে বা অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হয়। এই কারণে এটি খাওয়ার পর কিছু খাবার খাওয়া বা পানির সাথে মিশিয়ে পান করা উচিত।
রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা কমানো: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে আপেল সিডার ভিনেগার খেলে রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা কমতে পারে এবং হাড়ের ঘনত্ব কমে যেতে পারে। পটাসিয়ামের মাত্রা কমলে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং হাড়ের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া: আপেল সিডার ভিনেগার কিছু ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে এবং পটাসিয়ামের মাত্রা হ্রাস করতে পারে, যা ঔষধের কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে। যাঁরা নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ করছেন, তাঁদের উচিত আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
ত্বকের জ্বালা ও সংবেদনশীলতা: কিছু মানুষের ত্বকে আপেল সিডার ভিনেগার প্রয়োগ করলে জ্বালা, লালচে ভাব, বা এলার্জি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এটি ত্বকে প্রয়োগ করার আগে অবশ্যই পানি দিয়ে পাতলা করে নিতে হবে এবং সংবেদনশীল ত্বকে সরাসরি প্রয়োগ এড়িয়ে চলা উচিত।
গলা এবং মুখে জ্বালা: আপেল সিডার ভিনেগার সরাসরি পান করলে গলা এবং মুখে জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি হতে পারে। তাই এটি সবসময় পানি বা অন্য তরলের সাথে মিশিয়ে পান করা উচিত।.
ত্বকের পিএইচ ভারসাম্য ব্যাঘাত: ত্বকে অতিরিক্ত আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করলে ত্বকের প্রাকৃতিক পিএইচ ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যার ফলে ত্বক শুষ্ক বা জ্বালাযুক্ত হয়ে পড়তে পারে।
অতিরিক্ত ব্যবহারে ঝুঁকি: আপেল সিডার ভিনেগারের অতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে লিভার এবং কিডনিতে।
আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহারে সতর্কতা
প্রথমে অল্প পরিমাণে আপেল সিডার ভিনেগার পান করুন। অত্যধিক ভিনেগার আপনার গলা জ্বালা করতে পারে। দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভিনেগার কখনোই সরাসরি পানিতে না মিশিয়ে খাওয়া উচিত নয়। এই ভিনেগার আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, এটা সত্যি। যাইহোক, আপনি যখন অতিরিক্ত খান, তখন খাবার হজম হতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগে।
আরো পড়ুন: ভেন্নার তেল বা ক্যাস্টার অয়েল এর আশ্চর্যজনক উপকারিতা ও এর ব্যবহার।
ফলস্বরূপ, ক্ষুধা হ্রাস হতে পারে। ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য রোগের ওষুধের সাথে ভিনেগার গ্রহণ করলে উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে। তাই সঠিকভাবে ভিনেগার ব্যবহার করতে ভুলবেন না।আপনার যদি সংবেদনশীল ত্বক থাকে, তাহলে আপেল সিডার ভিনেগার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করুন। আপেল সাইডার ভিনেগার দাগ দূর করতে এবং দাঁত সাদা করতে ভালো। কিন্তু ভিনেগারে থাকা অ্যাসিড দাঁতের গোড়ায় গেলে ক্ষতিকর হতে পারে।
ভিনেগারের সাথে একটি তুলো সোয়াব নিন এবং হালকাভাবে আপনার দাঁতে লাগান। অনেক লোক বুঝতে পারে না যে আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার আগে বা পরে পান করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা খাবারের আধা ঘন্টা আগে বা পরে এটি পান করার পরামর্শ দেন। যদি আপনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বা অন্য কোনো ক্রনিক রোগের ওষুধ গ্রহণ করেন, তবে আপেল সিডার ভিনেগার গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
লেখকের মতামত
আপেল সিডার ভিনেগার বহুমুখী এবং প্রাকৃতিক উপাদান হওয়ায়, এটি দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকারী জিনিস। আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার বা ত্বকে ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যদি আপনার কোনো ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে বা আপনি ঔষধ গ্রহণ করেন। এটি ব্যবহারের সময় সবসময় সঠিক মাত্রা এবং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আমাদের আর্টিকেল সম্পর্কে কোন মতামত বা পরামর্শ থাকলে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ।
ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url