লটকনের আশ্চর্যজনক কিছু উপকারিতা ও লটকন খাওয়ার নিয়ম
লটকন ফল আমরা কম বেশি সবাই চিনি। আমরা সকলে লটকন ফল চিনে থাকলেও এর উপকার ও ব্যবহার সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানি না। আজ আমাদের আর্টিকেলের মাধ্যমে লটকন সম্পর্কে বিস্তারিত আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব।
আদিমকালে লটকন ফল জঙ্গলে পাওয়া যেত। বলতে গেলে ফলের তালিকায় লটকনের নাম ছিলই না। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকের জনপ্রিয় ফল হিসেবে এটি অবস্থান করছে। দেশের প্রায় সব জায়গায় এর চাহিদা বেড়ে গেছে। আজ আমরা লটকন ফল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পোস্ট সূচীপত্র
- লটকন ফলের পরিচয়
- লটকন গাছের বিবরণ
- লটকন ফলের চাষাবাদ
- লটকন ফল খাওয়ার পদ্ধতি
- লটকন ফল খাওয়ার সময়
- লটকন ফলের উপকারিতা
- লটকন ফলের অপকারিতা
- সতর্কতা
- লেখকের মতামত
লটকন ফলের পরিচয়
লটকন একটি গ্রীষ্মকালীন ফল যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটি বাংলাদেশসহ ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় জনপ্রিয় একটি ফল। লটকন ফলের আকার, রং, এবং স্বাদে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এটির পরিচিতি বাড়ায়।লটকনের বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea motleyana এটি Phyllanthaceae পরিবার গোত্রীয় উদ্ভিদ। স্থানীয় নাম বাংলায় লটকন বা রাম্বাই, মালয়েশিয়ায় রাম্বাই, থাইল্যান্ডে মাফাই। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি এবং বি-২ আছে, এটি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন- হাড়ফাটা, বুগি, ডুবি, বুবি, কানাইজু, লটকা, লটকাউ, কিছুয়ান ইত্যাদি।
আরো পড়ুন: ত্রিফলার উপকারিতা | ত্রিফলা যেসব রোগে ব্যবহার হয়ে থাকে।
লটকন ফল সাধারণত ছোট, গোলাকৃতি এবং হলুদ-কমলা রঙের হয়। ফলের মধ্যে তিন থেকে পাঁচটি সেগমেন্ট থাকে যা খাওয়ার উপযোগী। লটকন ফলের স্বাদ মিষ্টি ও খাস্তা, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প টক হতে পারে। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ফলটি, "বুবি" বা "Bubi" নামে সর্বাধিক পরিচিত। তাছাড়া "লটকা" " আঁশফল" ইত্যাদি আঞ্চলিক নাম ও আছে। ফলটি ত্রিপুরা, কাছাড় এবং বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ফলে। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে সময় এটি পরিপক্ক হয়।
লটকন গাছের বিবরণ
লটকন গাছ একটি বহুবর্ষজীবী গাছ যা ১০-২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছটি সুন্দর সবুজ পাতায় ঘেরা থাকে এবং ছোট ফুল ফোটায়। এর কাণ্ড বেটে এবং উপরাংশ ঝোপালো হয়ে থাকে। পুরুষ এবং স্ত্রী গাছ আলাদা; যাতে আলাদা ধরনের হলুদ ফুল হয়, উভয় রকম ফুলই সুগন্ধিযুক্ত। ফলের আকার দুই থেকে পাঁচ সেমি হয়, যা থোকায় থোকায় ধরে। ফলের রঙ সবুজ পাকলে হালকা হলুদ বা কমলা রং ধারণ করে। ফলের মধ্যে ২-৫ টি বীজ হয়, বীজের গায়ে লাগানো রসালো খাওয়ার জন্য কমলার কোষের মত অংশ থাকে, যা জাতভেদে টক বা টকমিষ্টি স্বাদের। এই ফল সরাসরি খাওয়া হয় বা জ্যাম তৈরি করা হয়। এর ছাল থেকে রঙ তৈরি করা হয় যা রেশম সুতা রাঙাতে ব্যবহৃত হয়।
লটকন ফলের চাষাবাদ
লটকন গাছ সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মায়। বৃষ্টি বেশি হয় কিন্তু পানি জমে থাকে না এমন জায়গা লটকন চাষের জন্য যথাযথ। সুনিষ্কাশিত প্রায় সব ধরনের মাটিতেই এটির চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ বা কাদা দোআঁশ, ক্ষারবিহীন, সামান্য অম্লযুক্ত মাটি লটকন গাছের জন্য উপযুক্ত। লটকন গাছ স্যাঁতসেঁতে ও আংশিক ছায়াময় পরিবেশে ভালো জন্মে। কিন্তু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ গাছ ভালো হয় বড় কোন গাছের নিচে রোপণ করলে। বাংলাদেশের মধুপুর অঞ্চলের জমি এ ফলের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। এটি বীজ থেকে সহজেই বৃদ্ধি পায় এবং ফুল ও ফল ধারণ করতে ৪-৫ বছর সময় নেয়। বীজর পাশাপাশি এটি গুটি কলমের মাধ্যমেও রোপন করা যায়। বরং বীজের চাইতে গুটি কলমে মাতৃগাছের গুনাগুন বেশি বজায় থাকে। বীজের গাছে ফল আসতে পাঁচ-ছয় বছর সময় লাগে কিন্তু কলমের গাছে দু-তিন বছর পর ফল ধরা শুরু করে।
লটকন ফল খাওয়ার পদ্ধতি
লটকন ফল সাধারণত তাজা খাওয়া হয়। এছাড়া এটি দিয়ে জ্যাম, জেলি এবং বিভিন্ন মিষ্টি পদ তৈরি করা যায়। ফলের পুষ্টিগুণ উচ্চ হওয়ায় এটি একটি স্বাস্থ্যকর খাবার হিসাবে বিবেচিত হয়। লটকন ফলের ঐতিহ্য ও জনপ্রিয়তা রয়েছে এবং এটি প্রায়ই স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। এর মিষ্টি স্বাদ ও স্বাস্থ্যগুণের জন্য এটি অনেকের প্রিয় ফল।
লটকন ফল তাজা খাওয়ার জন্য উপযুক্ত এবং এর মিষ্টি ও খাস্তা স্বাদ ভোজনরসিকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এই ফলটি কিভাবে খাওয়া যায় তা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
- তাজা ফল: লটকন ফল সাধারণত তাজা খাওয়া হয়। ফলটি খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া হয়, যেখানে ভিতরের সেগমেন্টগুলি সহজেই আলাদা করা যায়।
- জ্যাম ও জেলি: লটকন ফল থেকে জ্যাম, জেলি, এবং সস তৈরি করা যায়, যা রুটির সঙ্গে খাওয়া যায়।
- সালাদ ও ডেজার্ট: লটকন ফলের টুকরো সালাদে যোগ করা যায় অথবা বিভিন্ন ডেজার্ট আইটেমের সঙ্গে পরিবেশন করা যায়।
- জুস: লটকন ফলের রস তৈরি করে তাজা পানীয় হিসাবেও খাওয়া যায়, যা বিশেষ করে গরমের দিনে সতেজতা আনে।
লটকন ফল খাওয়ার সময়
লটকন ফলের সঠিক সময়ে এবং পদ্ধতিতে সেবন নিশ্চিত করলে এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে।
- ফলের মৌসুম: লটকন ফল সাধারণত গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে পাকে, যা জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে হয়। এই সময়ে ফলটি পাকা ও খাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত থাকে।
- সকালে: ভোরে লটকন ফল খাওয়া ভালো, কারণ এতে থাকা প্রাকৃতিক সুগার এবং ভিটামিন সি দিনের শুরুতে শরীরে শক্তি যোগায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- খালি পেটে নয়: অতিরিক্ত টক বা টক-মিষ্টি ফল খালি পেটে খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এটি পাকস্থলীর অম্লতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
লটকন ফলের উপকারিতা
লটকন একটি জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন ফল, যা সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। এই ফলটি সাধারণত মিষ্টি ও খাস্তা স্বাদের জন্য পরিচিত। নিচে লটকন ফলের কিছু প্রধান উপকারিতা তুলে ধরা হলো:
উচ্চ ভিটামিন সি কন্টেন্ট: লটকন ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং সর্দি-কাশির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস সমৃদ্ধ: এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস শরীরের ক্ষতিকর মুক্ত কণাকে নিরপেক্ষ করতে সাহায্য করে, যা বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়।
হজম শক্তি বৃদ্ধি: লটকন ফলের মধ্যে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয়।
চর্ম রোগ প্রতিরোধে সাহায্য: এই ফলের কিছু উপাদান চর্ম রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক: লটকন ফলে কম ক্যালোরি থাকায় এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
লটকন ফলের অপকারিতা
লটকন একটি জনপ্রিয় এবং উপকারী ফল হলেও এর কিছু অপকারিতা পরিলক্ষিত করা যায়। নিচে লটকন ফলের কিছু প্রধান অপকারিতা তুলে ধরা হলো:
অতিরিক্ত সেবনে সমস্যা: অতিরিক্ত লটকন ফল সেবন করলে পাকস্থলীতে অস্বস্তি হতে পারে, যেমন পেট ব্যথা বা অম্লতা।
অ্যালার্জির সম্ভাবনা: কিছু মানুষ লটকন ফলের প্রতি অ্যালার্জি হতে পারে, যার ফলে চর্মের প্রদাহ বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
রক্তচাপের উপর প্রভাব: লটকন ফলে প্রাকৃতিক সুগার থাকে যা উচ্চমাত্রায় সেবন করলে রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
সতর্কতা
পরিমিত সেবন: লটকন ফল মিষ্টি হলেও অতিরিক্ত সেবনে পেটের সমস্যা হতে পারে। তাই এটি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
আরো পড়ুন: বাতাবি লেবুু নানা রোগের মহাষৌধ | বাতাবি লেবুর উপকারিতা।
বীজ না খাওয়া: লটকন ফলের বীজ কাঁচা খাওয়া উচিত নয়, কারণ এটি সহজে হজম হয় না এবং বিষাক্ত হতে পারে।
সংরক্ষণ: লটকন ফল সংরক্ষণ করতে হলে ফ্রিজে রাখা ভালো, তবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ না করে তাজা অবস্থায় খাওয়া সবচেয়ে ভালো।
লেখকের মতামত
লটকন ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে অবগত থেকে সঠিকভাবে খেতে পারলে এটি একটি সুস্থ মানুষের জন্য অনেক উপকারী হতে পারে। তবে কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বা অ্যালার্জি থাকলে এটি খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আমাদের আর্টিকেল সম্পর্কে কোন মতামত বা পরামর্শ থাকলে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।
ধন্যবাদ
ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url