একটি আশ্চর্যজনক পাতা কারিপাতা। কারিপাতার উপকারিতা
পোস্টের সূচীপত্র
কারিপাতা পরিচিতি
কারিপাতার বৈজ্ঞানিক নাম Murraya Koenigii অথবা Bergera koenigii. এটি Rutaceae গোত্রের একটি ক্রান্তীয় বা উপক্রান্তীয় উদ্ভিদ। যা ভারত ও শ্রীলঙ্কা এর আঞ্চলিক উদ্ভিদ। এর পাতা ভারত ও পাশ্ববর্তী দেশসমূহে ঝোল জাতীয় রান্নায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে বলে একে কারি পাতা বলা হয়ে থাকে। এক ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় কাদি পাদা বা মিষ্টি নিম পাতা বলা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন: কেশরাজ/কালোকেশী পাতার গোপনীয় কিছু কার্যকারীতা।
মালয়ালম ভাষায় করিভেম্পু এবং তামিল ভাষায় করিভেপিলােই ইত্যাদি নামে পরিচিত। কারি পাতা অনেকটা তেজপাতের মত কিন্তু আকারে একটু ছোট। এটি ভারতীয় তেজপাতা নামে পরিচিত। এর পাতার মধ্যে একটি উদ্বায়ী তেলের উচ্চ উপাদান রয়েছে। যা একটি সুগন্ধযুক্ত সুবাস দেয়। এর পাতা সামান্য তিক্ত স্বাদ যুক্ত। এই পাতা কেবলমাত্র খাবারগুলোতে সুগন্ধ বা স্বাদ আনতে ব্যবহার করা হয় না এগুলো খাবারের স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
গাছ পরিচিতি
এটি একটি ছোট উদ্ভিদ যা ৪-৬ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। যার গুড়ির ব্যাস ১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সুগন্ধি পাতাগুলো পক্ষল, প্রতি গুচ্ছে ১১-২১ টি করে পাতা থাকে। প্রতিটি পাতা ২-৪ সে.মি লম্বা ও ১-২ সে.মি প্রশস্ত হয়ে থাকে। এই গাছে সাদা ফুল হয় যেটি নিজে নিজে পরাগায়িত হয়ে চকচকে রসালো ফল উৎপন্ন করে। ফলের ভিতরে একটি বীজ থাকে। এই ফলটির শাঁস খাওয়া যায়। এটি অনেকটা মিষ্টি স্বাদের ও ঔষধের মত সুগন্ধযুক্ত হয়। এই গাছের পাতা ছাড়া ফুল বা ফল রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয় না।
কারি পাতার ধরন কারিপাতা তিন ধরনের হয়ে থাকে। নিন্মে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।- নিয়মিত: নিয়মিত কারিপাতার কোনো সুগন্ধ নেই। এটির গাছ বেশ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং উচ্চতায় অনেক লম্বা হয়ে থাকে। এগুলো সহজেই মুদি দোকানে পাওয়া যায়।
- বামন: বামন ধরনের গাছ উচ্চতায় ছোট থাকে কিন্তু এর পাতা লম্বা আকৃতির হয়ে থাকে। এই পাতায় সুগন্ধ কম মাত্রায় পাওয়া যায় কিংবা একবারেই পাওয়া যায় না। এই পাতা গুলো রান্নার কাজের চেয়ে ভেষজ হিসেবে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।
- গামথি: গামথি বা ক্ষুদ্র কারি পাতার গাছে পাতা অত্যন্ত ঘন হয়ে থাকে। এই পাতা গুলো বৃদ্ধি পেতে অনেক সময়ে নিয়ে থাকে। এই প্রজাতির পাতাগুলো সুগন্ধিযুক্ত হয়ে থাকে। এগুলোই রান্নার কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে।
গাছ রোপন পদ্ধতি
বীজঃকারিপাতা গাছ রোপন করার জন্য বীজ অবশ্যই পাকা ও সতেজ হতে হবে। শুকনো অথবা কোঁকড়ানো ফল ব্যবহার করা যাবে না। এই ফলটি সম্পূর্ণ রোপন করা যায়। তবে ফলের শাঁসটি ছাড়িয়ে নিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় কিন্তু ভেজা নয় এমন জায়গায় রোপন করতে হবে। কারিপাতা বীজের পাশাপাশি কলম পদ্ধতিতেও রোপন করা হয়ে থাকে।
সময় ও জায়গাঃকারিপাতা লাগানোর উপযুক্ত সময় হলো বসন্তের শুরুতে। পূর্ণ রোদে এই গাছটি ভালোভাবে বেড়ে উঠে। তবে চারা রোপনের সময় এটি ছায়াযুক্ত জায়গায় রাখতে হবে। গাছটি মাটির সাথে লেগে গেলে তখন রোদে রাখলে আর কোন সমস্যা হবে না।
মাটিঃ কারি পাতা যে কোন ধরনের মাটিতে জন্মে। তবে ভালো ভাবে বৃদ্ধির জন্য নিষ্কাশন করা উর্বর মাটি এটি রোপনের জন্য বেশি উপযুক্ত। গাছটি যখন বাড়তে থাকবে তখন নিয়মিত পানি দিতে হবে।গাছটি যখন পরিপক্ক হয়ে যাবে তখন আর পানি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
আরো পড়ুন: পাথরকুচি পাতার উপকারিতা।
পরিচর্চাঃ তাজা পাতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত গাছটি ছাটাই করতে হবে। এর মরা পাতা ও ডালপালা গুলো ছাটাই করতে হবে। কারি পাতার গন্ধ বিভিন্ন পোকা মাকড় দুরে রাখে তবে কিছু কীট পতঙ্গ আছে যা গাছের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে এফিডস, স্কেল, সাইলিডস এবং মেলিবাগ।কারিপাতার উপকারিতা
- রক্তের খারাপ চর্বির পরিমান কমাতেঃ কারিপাতা রক্তের খারাপ চর্বির পরিমান কমাতে খুবই সাহায্য করে থাকে। কারিপাতা রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড ও খারাপ কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমাতে খুবই কার্যকারী।
- টক্সিন দূর করতেঃ কারিপাতায় প্রচুর পরিমানে এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীর থেকে টক্সিন দূর করে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
- ক্ষত চিকিৎসায়ঃ কারিপাতা যেকোন প্রকার ক্ষত সারাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি ক্ষত, ফোঁড়া, ফুসকুড়ি এবং হালকা পোড়া নিরাময় করতে সাহায্য করে। কারিপাতারে পেস্ট তৈরি করে তা ক্ষত, ফোঁড়া, ফুসকুরি এবং হালকা পোড়া জায়গার উপর প্রলেপ দিলে অনেক আরাম পাওয়া যায় এবং তা নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে।
- দাঁতের চিকিৎসায়ঃ প্রতিদিন সকালে ৪-৫ টুকরা কারিপাতা চিবিয়ে খেলে এটি মুখের অভ্যন্তরে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তাছাড়া কারিপাতা মাড়িকে শক্তিশালী রাখতেও ভূমিকা পালন করে থাকে।
- চোখের জন্যঃ কারিপাতায় প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ থাকায় এটি চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে থাকে।
- রক্ত তৈরির ক্ষেত্রেঃ কারিপাতায় রয়েছে আয়রন ও ফলিক এসিড। যা রক্তস্বল্পতা রোধ করে এবং রক্ত তৈরি করে থাকে। তাছাড়া এই পাতা শরীরে লোহিত রক্ত কনিকার সংখ্যা বজায় রাখতে সাহায্য করে থাকে।
- এন্টি ডায়াবেটিক ও এন্টি ব্যাকটেরিয়ালঃ কারিপাতা এন্টিডায়াবেটিক হওয়ায় এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে থাকে এবং এন্টি ব্যাকটেরিয়াল হওয়ায় শরীরের বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে থাকে।
- কারিপাতায় অত্যন্ত দক্ষ এন্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট রয়েছে। ভিটামিন এ এবং সি এর সাথে যুক্ত হলে পাতাগুলি আরও কার্যকর হয়ে উঠে।
- কারিপাতা সকালের অসুস্থতা ও বমি বমি ভাব দূর করতে সাহায্য করে।
- কারিপাতা চুল পড়া রোধে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে নাস্তার করার কিছুক্ষন আগে কয়েকটি কারিপাতা চিবিয়ে খেলে চুল পড়া রোধ হয়। এছাড়া এটি খুশকি ও ফ্ল্যাকি স্কাল্প রোধ করতে সহায়তা করে।
- কারিপাতা নিয়মিত খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এটি অ্যাসিডিটি থেকে মুক্ত করে থাকে।
কারিপাতার অপকারিতা
কারিপাতার অপকারিতা খুবই সীমিত এবং সাধারণত নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। নিচে কিছু সম্ভাব্য অপকারিতা উল্লেখ করা হলো:
অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া: কিছু লোক কারিপাতার প্রতি অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এর ফলে ত্বকে র্যাশ, চুলকানি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
পরিমাণ অতিরিক্ত খাওয়া: অতিরিক্ত পরিমাণে কারিপাতা খেলে পেটে সমস্যা হতে পারে, যেমন গ্যাস, অম্বল, বা ডায়রিয়া।
ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া: যদি কেউ নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ করে থাকেন, তবে কারিপাতা তার প্রভাবকে পরিবর্তন করতে পারে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের ঔষধের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
গর্ভাবস্থা এবং স্তন্যদান: গর্ভাবস্থা বা স্তন্যদানকালে অতিরিক্ত কারিপাতা খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url