চিনিপাতা গাছের অজানা উপকারিতা ও অপকারিতা
চিনিপাতা গাছ আমরা অনেকই চিনি না। চিনি পাতা হলো একপ্রকার ঔষধি গাছ। আমাদের চারপাশে এমন অনেক গাছ আছে যেগুলো আমরা ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। ঠিক তেমনি একটি গাছ হলো চিনিপাতা। আজ আমরা এর উপকারিতা ও অপকারিতা গুনাগুন সম্পর্কে জানব।
চিনিপাতা গাছ সম্পর্কে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পুরো পড়ুন। আর্টিকেলটি পুরো পড়লে আপনি চিনিপাতা গাছ সম্পর্কে জানতে পারবেন। চিনিপাতা গাছ কোথায় পাওয়া যায়, এই গাছের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আজকের আর্টিকেলে সব জানতে পারবেন।
পোস্ট সূচীপত্র
চিনিপাতা গাছ কি
চিনিপাতা গাছ হচ্ছে চিনির বিকল্প। যা চিনির চেয়ে ৫০ থেকে ৩০০ গুন পর্যন্ত বেশি মিস্টি হয়ে থাকে। এই চিনিপাতা। এটি দক্ষিন আমাজান রেইন ফরেস্টের প্যারাগুয়ে এবং ব্রাজিল অঞ্চলের একটি উদ্ভিদ। বর্তমানে বাংলাদেশে এর ব্যাপক চাহিদা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি এক প্রকার ঔষধি গাছ। এই গাছ বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
চিনিপাতা গাছ পরিচিতি
চিনি পাতা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Scoparia dulcis. এটি Scrophulariaceae গোত্রের একটি গাছ। এই গাছটি বাংলাদেশে তথা বিশ্বে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন-ফুরফুরি, তালমাকনা, বনধুনি, বন ধনিয়া, বন্দনী, মিছরিদানা, চিনিগুড়া, বাখর গাছ, মিডালী, চিনিটোরা, চিনিমিঠা, Goatweed, Sweet broom ইত্যাদি নামে পরিচিত।
আরো পড়ুন: কারিপাতার উপকারিতা।
চিনিপাতা গাছ হলো বর্ষজীবী শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট চিরসবুজ বিরুৎ শ্রেণীর সপুষ্পক গুল্ম উদ্ভিদ বা আগাছা যার ইংরেজি নাম sweet broom. এ গাছ প্রায় ৯০ সে.মি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। কান্ড কিছুটা দৃঢ়, শিরাবিশিষ্ট ও লোম বিহীন। পাতাগুলো বল্লমাকৃতির, কিনারা দাঁতের মতো খাঁজকাটা থাকে। খাটো বোটা বিশিষ্ট পাতাগুলোর কান্ডের উপর একটি অন্যটির বিপরীতে সাজানো থাকে।
সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল হয়। ফুলগুলো প্রায় ৩ সে.মি ব্যাসার্ধ ও বোটাযুক্ত হয়ে থাকে। ফুলে ৪টি করে বৃতি ও পাঁপড়ি থাকে। এই গাছে ফুল থেকে ফল হয়ে থাকে। ফলগুলো গোলাকার ধরনের ও ক্যাপসুলজাতীয় হয়ে থাকে। এই ফলগুলোর ব্যাসার্ধ প্রায় ০.৫ সি.মি হয়ে থাকে। এটি বর্ষা ঋতুতে অর্থাৎ মে থেকে জুন মাসে ফুল দিয়ে থাকে। বীজের সাহায্যে এই গাছ বংশবিস্তার করে থাকে।
চিনিপাতা গাছের চাষ পদ্ধতি
চিনিপাতা গাছ সাধারনত রোদ পছন্দের একটি গাছ। এই গাছটি ছোটদিনের একটি উদ্ভিদ। এই গাছটি রোদপ্রিয় হলেও ১২ঘন্টার উপর রোদ এই গাছের জন্য ক্ষতিকর। চিনিপাতা গাছ জৈবসার যুক্ত এবং নিষ্কাষনযুক্ত দো আশ মাটিতে ভালো হয়। সাধারনত এই গাছ ১৫-৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চাষ ভালো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এই গাছ চাষের জন্য মোটামুটি উপযোগী।
চিনিপাতা গাছ বাংলাদেশে কবে আসে
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০১ সালে ইক্ষু গবেষণা ইন্সিটিটিউট মানবদেহের জন্য উপকারী এই গাছটি থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করে। দীর্ঘ গবেষণার পর ঈশ্বরদী ও ঠাকুরগাঁয়ে চিনিপাতা গাছ চাষাবাদ শুরু হয় এবং এর থেকে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য চা তৈরি করা হয়। ঠাকুরগাঁও সুপার ক্রপস গবেষণার কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ শরিফুল ইসলাম জানান স্টেভিয়া প্রজাতির এই উদ্ভিদ চিনি অপেক্ষা ৩০ থেকে ৪০ গুন বেশি মিষ্টি। এর গুনাগুন হলো ডায়াবেটিস রোগীরা এটি সেবন করলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমান পরিবর্তিত হয় না।
চিনিপাতা গাছের উপকারিতা
চিনিপাতা গাছের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে হলে আগে এই পাতা সম্পর্কে জানতে হবে। চিনিপাতাকে স্টেভিয়া নামে ডাকা হয়। এই গাছটি সর্বপ্রথম ১৯৬৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয় প্যারাগুয়েতে। তারপর আস্তে আস্তে ব্রাজিল,কোরিয়া, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর বানিজ্যিক ভাবে এর চাষাবাদ শুরু হয়।
ঠাকুরগাঁও সুপার ক্রপস গবেষণার কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ শরিফুল ইসলাম জানান স্টেভিয়া প্রজাতির এই উদ্ভিদ চিনি অপেক্ষা ৩০ থেকে ৪০ গুন বেশি মিষ্টি। এর গুনাগুন হলো ডায়াবেটিস রোগীরা এটি সেবন করলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমান পরিবর্তিত হয় না।
চিনিপাতা গাছ মূলত একটি ঔষধি গাছ। এই গাছের অনেক গুনাগুন রয়েছে। এখন আমরা এই গাছের উপকারিত সম্পর্কে আলোচনা করব।
ওজন কমানোর জন্য: চিনিপাতা গাছ চিনি অপেক্ষা ৩০ থেকে ৪০ গুন বেশি মিষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এর ক্যালরি খুবই কম। তাই যারা ওজন কমাতে চাচ্ছেন তারা এই গাছের গুড় বা পাতা ব্যবহার করতে পারেন। এই গাছের পাতা ও গুড়া ওজন কমাতে যথেষ্ট গুরুত্ব রাখে। তাছাড়া চিনিপাতা গাছ রক্তের ইনসুলিন এর মাত্রা বৃদ্ধিতে বাধা দেয় যা ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: চিনিপাতা গাছ উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। চিনিপাতা গাছের পাতাতে রয়েছে খনিজ, বিটা ক্যারেটিন এবং ভিটামিন সি যা আপনার শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে। এমনটি চিনিপাতার রস রক্তনালীকে শীতল করে দেয় যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে থাকে। আপনি যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখতে চান তবে চিনিপাতা ব্যবহার করতে পারেন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে: চিনিপাতা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। এই গাছের পাতা চিনি অপেক্ষা ৩০ থেকে ৪০ গুন বেশি মিষ্টি হওয়া সত্ত্বেও ডায়াবেটিস রোগীরা এটি সেবন করলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমান পরিবর্তিত হয় না। ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রেনে থাকে।
আমাশয়, গ্যাস্টিক ও আলসারের জন্যঃ চিনিপাতা গাছের পাতার রস আমাশয় রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এত অনেক উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া গ্যাস্টিক ও আলসারের জন্য এই গাছের পাতার রস অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
রক্তের শর্করা ঠিক রাখতে: আপনি যদি রক্তের শর্করা ঠিক রাখতে চান তবে আপনার জন্য চিনিপাতা গাছের পাতার রস সাহায্য করতে পারে। চিনিগুড়া গাছের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো এটি রক্ত সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ে ভালো ফলাফল দিয়ে থাকে। রক্তের শর্করা ঠিক রাখতে এই গাছের পাতা খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে: চিনিপাতা গাছের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকার হলো এটি আমাদের হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা ঠিক রাখে। আপনি যদি হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে চান তাহলে আপনি চিনিপাতা গাছ ব্যবহার করতে পারেন। এই গাছটি যেহেতু চিনির বিকল্প তাই এই গাছটি হৃদপিন্ডের জন্যও অনেক উপকারী।
হৃদপিন্ডের ক্ষতিকর জিনিসের মধ্যে চিনি হলো অন্যতম।এই গাছের পাতাতে যেহেতু ক্যালরি অনেক কম আবার চিনির চেয়েও বেশি মিষ্টি তাই এই গাছের পাতা আপনি নিশ্চিতে ব্যবহার করতে পারেন। জাপানে বর্তমানে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ এখন চিনির পরিবর্তে বর্তমানে এই গাছের পাতা ব্যবহার করে থাকেন।
আরো পড়ুন: পাথরকুচি পাতার উপকারিতা।
ডায়রিয়ার জন্যঃ ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসায় এই গাছের পাতার রস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাসিয়া উপজাতিয় মানুষেরা ডায়রিয়া চিকিৎসায় এই গাছের পাতা ব্যবহার করে থাকে।
জ্বর বা ম্যালেরিয়া: চিনিপাতা গাছের পাতা জ্বর বা ম্যালেরিয়া সারাতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। এই গাছের পাতার রস এক সপ্তাহ খেলে জ্বর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
মুখের ঘা এর চিকিৎসা: মুখের ঘা এর জন্য এই গাছের পাতা যথেষ্ট কার্যকরী। এই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে মুখের ঘা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।
দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায়: চিনি পাতার রস মুখের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার সাথে যুদ্ধ করে এর বৃদ্ধি ও গঠনে বাধা প্রদান করে থাকে। যার ফলে গহ্বর ও মাড়ির সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
ত্বকের জন্য: চিনিপাতা গাছের পাতার রয়েছে এন্টি রিঙ্কেল বৈশিষ্ট যা আপনার ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে এবং ত্বককে বিভিন্ন একজিমা থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে থাকে।
চিনিপাতা গাছের ব্যবহার
চিনিপাতা গাছের পাতা, গাছ, কান্ড, ফুল ও ফল সবই চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। চিনিপাতা গাছের কিছু ব্যবহার নিন্মে আলোচনা করা হলো:
- রক্ত আমাশয়ে ক্ষেত্রে এই গাছের রস যত কম হবে এর কার্যকারিতা তত বেশি হবে। রক্ত আমাশয়ের জন্য এক চা চামচ পরিমান রস পর পর তিন দিন খেলে আশা করা যায় রক্ত আমাশয় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
- চিনিপাতা ও ফল কাম উদ্দিপক হিসেবে খুবই পরিচিত। এই গাছের পাতা ও ফল ৫ থেকে ৭ দিন ধরে খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
- মুখের যা এর জন্য এই গাছের পাতা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে তা চিবুতে থাকলে কয়েকদিনের মধ্যে মুখের ঘা থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়।
- শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার কারণে এই গাছের পাতা, ফল ও শিকড় একত্রে বেটে তা কয়েকদিন খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
- ক্ষুদা মন্দা দেখা দিলে এই গাছের শিকড় বেটে খেলে ক্ষুদামন্দা দূর হয়ে যায়।
- চোখে রক্ত জমাট বাঁধলে এই গাছের পাতার রস দিনে দুই ফোঁট করে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
- জ্বর বা ম্যালেরিয়া জ্বরের ক্ষেত্রে এর গাছের পাতার রস দিনে দুই চা চামচ করে এক সপ্তাহ বা উপসম হওয়া পর্যন্ত খাওয়া যেতে পারে।
- গনোরিয়া, মাথাব্যথা, জন্ডিস, কানব্যাথায় এই গাছের পাতার রস ব্যবহার করা যেতে পারে।
চিনিপাতা গাছের অপকারিতা
চিনিপাতা গাছের অনেক উপকার থাকা সত্ত্বেও কিছু অপকারিতা রয়েছে। নিন্মে এর মধ্যে হতে কিছু অপকারিতা আলোচনা করা হলো।
- অতিরিক্ত চিনিপাতা গাছের পাতার রস খেলে বমি বমি ভাব আসতে পারে। অনেকে মাথা ব্যাথা, পেশি ব্যথা ও অসাড়তার সম্মুখীন হতে পারেন পারেন। তাই এটি পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
- চিনিপাতা বেশি পরিমানে খেয়ে ফেললে হজমে সমস্যা হতে পারে।
- চিনিপাতা যেহেতু রক্তনালীকে ঠান্ডা করে রক্তচাপ কমিয়ে দেয় সেহেতু যাদের রক্ত চাপ কম থাকে তারা যদি বেশি পরিমানে এটি খেয়ে ফেলেন তাহলে তাদের রক্তচাপ কমে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।
- চিনি পাতা ব্যবহারে কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এলার্জির প্রতিক্রিয়ার কথা জানা গেছে। যার ফলস্বরূপ চুলকানি দেখা দিতে পারে।
- চিনিপাতা ব্যবহারের ফলে কিছু কিছু মানুষের শরীরে ফোলা ফোলা ভাব আসতে পারে
লেখকের মতামত
চিনিপাতা গাছের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাশ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যদিও তা বিরল। কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে এলার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যে কোন রোগের চিকিৎসার জন্য চিনিপাতা ব্যবহারের উপায়, পরামর্শ ও সঠিক ব্যবহারের জন্য বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা সমীচীন হবে।
ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url