পাথরকুচি পাতা এক মহাষৌধ | পাথরকুচি পাতার উপকারিতা

পাথরকুচি পাতা সম্পর্কে আপনারা অনেকে জানতে চান। আমরা পাথরকুচি গাছ চিনে থাকলেও এই গাছের ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কোন ধারনা নেই। আমাদের আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা পাথরকুচি পাতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরব।

পাথরকুচি-পাতা-এক-মহাষৌধ

পাথরকুচির গাছ কম বেশি আমরা সবাই চিনি। প্রাচীনকাল থেকে যেসব কাজ চিকিৎসা ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তার মধ্যে পাথরকুচির পাতা অন্যতম। আজ আমরা পাথরকুচি পাতার সম্পর্কে আমাদের আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পোস্ট সূচীপত্র

পাথরকুচি পরিচিতি

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পাথরকুচি পাতা কে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী বলে মনে করা হয়। পাথরকুচির বোটানিক্যাল নাম Kalanchoe Pinnata (Lamk.(। পাথরকুচির পাতা  যুবক থেকে শুরু করে শিশু বুদ্ধ সবাই ব্যবহার করতে পারে। তবে বড়দের জন্য এর পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়।পাথরকুচির বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। অধিকাংশ জায়গায় এটি পাথরকুচি নামে পরিচিত। কিছু কিছু জায়গায় পাথান বেইথ  বা পাষাণ ভেদ নামেও পরিচিত।

আরো পড়ুন: সকালে খালি পেটে কাঁচা পেঁপে খাওয়ার উপকারিতা।

পাথরকুচি যা সাধারণত ‘পাথরকুচি পাতা’ নামে পরিচিত। এটি এক প্রকার ঔষধি গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Bryophyllum pinnatum। এই উদ্ভিদটি ক্রাসুলাসি (Crassulaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি বিশ্বের উষ্ণ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। পাথরকুচি পাতাগুলো মোটা, মসৃণ এবং রসালো হয়। পাতার প্রান্তে ছোট ছোট গাছের চারা জন্মাতে দেখা যায়। যেখান থেকে নতুন গাছ তৈরি হয়। এর ফুলগুলো সবুজাভ বা গোলাপি রঙের হতে পারে এবং গাছের শীর্ষে জন্মায়। পাথরকুচি পাতা দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি সাধারণত জ্বর, পেটের সমস্যা, ক্ষত এবং কিডনি সমস্যা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।

পাথরকুচির চারা/কলম, বংশবিস্তার পদ্ধতি

পাথরকুচির চারা উৎপাদনের জন্য তেমন কোন কষ্ট করতে হয় না। এর বংশবিস্তার হয় প্রাকৃতিকভাবেই। পাথর কুচি গাছের পাতার সাইটে যে খাঁজ কাটা অংশ থাকে সেখান থেকেই ছোট ছোট চারা গজায়। এগুলো শুধুমাত্র মাটিতে পুঁতে দিলেই এর থেকেই গাছ হয়ে যায়। এগুলো যত্নের তেমন একটা প্রয়োজন নেই। শুধু মাঝে মাঝে একটু পানি দিলেই এই গাছ সহজেই টিকে যায়। পাথরকুচি পাতা রোপনের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। বছরের যেকোন সময়েই এই গাছ রোপন করা যায়। 

পাথরকুচি পাতা প্রায় সব রকম মাটিতেই চাষাবাদ করা যায়। পাথরকুচি পাতা ভেঁজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রেখে দিলেই তা থেকেই চারা তৈরি হয়ে যায়। পাথরকুচি গাছ একটি একটি ঔষধি উদ্ভিদ। এটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছ সাধারণত দেড় থেকে তিন ফুট উঁচু হয়ে থাকে। এর পাতা মাংসল এবং মসৃণ হয়ে থাকে। এর পাতার কিনারায় খাঁজ কাটা থাকে। পাতা দেখতে অনেকটা ডিম্বাকৃতির। এর ফুল দেখতে অনেকটা ঝাড়বাতির মত। ফুলের বাইরের দিকে সবুজ লাল ও সাদা দাগ থাকে। এটির ফুল সাধরণত শীতকালে হয় এবং গ্রীষ্মকালে ফল হয়ে থাকে।

পাথরকুচি পাতার ব্যবহার

পাথরকুচি বিভিন্ন প্রকার রোগে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাথরকুচির পাতা সাধারণত ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। নিন্মে পাথরকুচি পাতার ব্যবহার আলোচনা করা হলো।

  • মেহঃ সর্দি জনিত কারণে অনেকের শরীরে ফোড়া হয়ে ব্যথা হয়। একে মেহ বলে। পাথর কুচি পাতার রস সকালে এক চামচ ও বিকেলে এক চামচ খেলে উপকার পাওয়া যায়।
  • শিশুদের পেট ব্যথাঃ শিশুদের পেট ব্যথা হলে পাথরকুচির পাতা অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। 
  • পেট ফাঁপাঃ অনেকের দেখা যায় মাঝে মাঝে পেট ফাঁপে। পেট ফুলে থাকে।প্রসাব আটকে আছে বা বায়ূ সরছে না সেই ক্ষেত্রে পাথরকুচি পাতার রস গরম করে সিকি কাপ পানির সাথে মিশিয়ে হাল্কা চিনি দিয়ে খাওয়াতে হবে। এতে অনেক ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
    পাথরকুচি-পাতার-উপকারিতা
  • কিডনির পাথরঃ কিডনি পাথর অপসারণে পাথরকুচির পাতা সহায়তা করে থাকে।
  • মৃগী রোগের ক্ষেত্রেঃ মৃগী রোগের ক্ষেত্রে পাথরকুচির কথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন ব্যক্তি যদি এই রোগে আক্রান্ত হয় তবে দুই থেকে ১০ ফোটা পাথরকুচি পাতার রস মুখে দিলে তা থেকে কিছুটা পেটে গেলে তা থেকে উপশম পাওয়া যায়।
  • পাইলস ও অর্শ্বঃ পাইলস ও অর্শ রোগের ক্ষেত্রে পাথরকুচি পাতা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। পাথরকুচির পাতা গোলমরিচের সাথে মিশিয়ে খেলে পাইলস ও অর্শ্ব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • লিভারের সমস্যাঃ লিভারের নানাবিধ সমস্যায় পাথরকুচির পাতা খুবই কার্যকরি একটু ওষুধ। জন্ডিস রোগের ক্ষেত্রে পাথরকুচির পাতার রস ও এর জুস অনেক ভালো কাজ করে।
  • শরীরের জ্বালাপোড়াঃ আমাদের মধ্যে অনেকেরই শরীর জ্বালাপোড়া করে। শরীর জ্বালাপোড়ার ক্ষেত্রে পাথরকুচির পাতা অত্যন্ত কার্যকারী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। পাথরকুচি পাতার রস আধা কাপ পানির সাথে মিশিয়ে গরম করে ঠান্ডা করে নিতে হবে । তারপর সকাল বিকাল পান করলে শরীরের জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • ত্বকের যত্নঃ ত্বকের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রেও পাথরকুচির পাতা অত্যন্ত ভালো কাজ করে। পাথরকুচির পাতায় পানির পরিমান বেশি হওয়ায় এটির পাতা বেঁটে ত্বকে লাগালে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
  • উচ্চ রক্তচাপঃ যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে তাদের জন্য পাথরকুচির পাতা একটি উত্তম পাথেয় হতে পারে। পাথর কুচির পাতা উচ্চ রক্তচাপ ও মুত্রনালির সমস্যা ক্ষেত্রে কার্যকরী ঔষধ।
  • চুলের যত্নেঃ অধিকাংশ মানুষের দেখা যায় তাদের চুল উঠার সমস্যা বিদ্যমান। পাথরকুচির পাতা চুল উঠে যাওয়ার সমস্যার ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর। পাথরকুচি পাতার রস চুলে ব্যবহার করলে চুল উঠা কমে যায়। চুল উঠা ছাড়াও এটি খুশকি দূর করতে সহায়তা করে। তাছাড়া এটি মাথায় ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

পাথরকুচি পাতার উপকারিতা

পাথরকুচি পাতা ঔষধি গুণে ভরপুর এবং বহু প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। নিন্মে পাথরকুচি পাতার কিছু প্রধান উপকারিতা উল্লেখ করা হলো:

  • কিডনির পাথর দূরীকরণ: পাথরকুচি পাতার রস কিডনির পাথর গলাতে সাহায্য করে। এটি নিয়মিত খেলে কিডনির পাথর গলে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যেতে পারে।
  • ক্ষত সারানো: পাথরকুচি পাতার রস বা পেস্ট ক্ষতস্থানে লাগালে তা দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং আরোগ্য লাভ হয়। এটি প্রদাহ কমাতে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
  • জ্বর নিয়ন্ত্রণ: এই পাতার রস জ্বর কমাতে কার্যকরী। এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরিয়ে আনে।
  • অম্বল ও পেটের সমস্যা: পাথরকুচি পাতা অম্বল, পেটে গ্যাস, এবং বদহজম সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হয়। এটি পেটের অম্লতা কমায় এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: পাথরকুচি পাতা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। এর পটাসিয়াম সমৃদ্ধ উপাদান রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী।
  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: পাথরকুচি পাতার রস রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি উপকারী।
  • প্রদাহ ও ব্যথা নিরাময়: পাথরকুচি পাতা প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে কার্যকরী। এটি প্রাকৃতিক ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে।
  • পেশী বা গাঁটে ব্যথা: পেশী বা গাঁটে ব্যথা হলে পাথরকুচি পাতার রস লাগালে তা দ্রুত উপশম হয়।
  • ত্বকের যত্ন: পাথরকুচি পাতা ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় যেমন ফুসকুড়ি, চুলকানি বা র‌্যাশ নিরাময়ে কার্যকর। এটি ত্বককে স্বাস্থ্যকর ও উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে।

পাথরকুচি পাতার অপকারিতা

পাথরকুচি পাতা যদিও বিভিন্ন ঔষধি গুণের জন্য পরিচিত, তবে এর কিছু সম্ভাব্য অপকারিতাও রয়েছে। বিশেষত যদি এটি অতিরিক্ত বা ভুলভাবে ব্যবহৃত হয়। নিন্মে পাথরকুচি পাতার কিছু অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেওয়া হলো:

  • অতিরিক্ত ব্যবহারে কিডনির সমস্যা: পাথরকুচি পাতার অতিরিক্ত ব্যবহারে কিছু ক্ষেত্রে কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে যদি কারো কিডনি আগে থেকেই দুর্বল থাকে, তাহলে তা আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
  • অ্যালার্জি বা ত্বকের সমস্যা: কিছু লোকের ক্ষেত্রে পাথরকুচি পাতা ব্যবহারে ত্বকে অ্যালার্জি, র‌্যাশ বা চুলকানি হতে পারে। তাই সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করার আগে সামান্য অংশে পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।
    পাথরকুচি-পাতার-অপকারিতা
  • হজমজনিত সমস্যা: অতিরিক্ত পাথরকুচি পাতা সেবনে ডায়রিয়া, বমি বা পেটে অস্বস্তি হতে পারে। এটি হজম প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
  • গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকি: গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পাথরকুচি পাতা ব্যবহার কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। গর্ভের সন্তানের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা না থাকায় এটি ব্যবহারের আগে গর্ভাবতী মহিলাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • ব্লাড সুগার কমে যাওয়া: যেহেতু পাথরকুচি পাতা রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, তাই ডায়াবেটিস রোগীরা যদি এটি অতিরিক্ত গ্রহণ করেন, তবে তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
  • রক্তচাপ হ্রাস: উচ্চ রক্তচাপের জন্য পাথরকুচি পাতা উপকারী হলেও এটি অতিরিক্ত ব্যবহারে রক্তচাপ খুব কমে যেতে পারে, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

লেখকের মতামত

পাথরকুচির পাতা প্রাচীন কাল থেকেই চিকিৎসার জন্য পাথেয় হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। পাথরকুচির পাতা অনেক উপকারী একটি ঔষধি উদ্ভিদ। পাথরকুচির পাতা উপকারী হলেও কিছু ক্ষেত্রে যেমন এলার্জির সমস্যা ও  গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাই এই পাতা ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে এই গাছের পাতা ব্যবহার করা সমীচীন হবে। আমাদের আর্টিকেল সম্পর্কে কোন মতামত বা পরামর্শ থাকলে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

ধন্যবাদ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডেইলীবিডিটেক নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url